খায়রুলের হাতে ওয়ালমার্ট, ই-বে আমাজনের ভান্ডার

নিজস্ব প্রতিবেদক: ‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে/কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে?’ সেই কবে লিখেছিলেন কুসুমকুমারী দাশ। কবির এই প্রত্যাশা নিশ্চয় পূরণ করেছে অনেক ‘ছেলে’। তবে রাজশাহীর ছেলে খায়রুল আলমকে দেখলে কবি নিশ্চিতভাবে খুশি হতেন। যাঁর একদিন কম্পিউটার কেনারও টাকা ছিল না, তিনি এখন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ফোর্বস, দা ইকোনমিস্টের ভাষায় ‘ফ্রিল্যান্সিংয়ের জন্য রোল মডেল’।

খায়রুলের প্রতিষ্ঠান ‘ফ্লিট বাংলাদেশ’। তিনি এ প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও)। রাজশাহী নগরীর নওদাপাড়ায় প্রধান কার্যালয়। এখানে আছে আরও দুটি অফিস। এ ছাড়া রাজশাহীতেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হাইটেক পার্ক, নগরীর ফুলতলা, বারোরাস্তার মোড়, উপশহর আর মালদা কলোনিতে আছে একটি করে অফিস। ঢাকাতেও একটা অফিস করার পরিকল্পনা আছে খায়রুলের। সব ঠিক থাকলে আগামী নভেম্বরেই চালু হতে পারে অফিসটি।

এই সেদিনের কথা

খায়রুল উচ্চমাধ্যমিক শেষ করেন ২০০৭ সালে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছিলেন। সুযোগ হয়নি। ঢাকায় গিয়ে ভর্তি হন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। পড়াশোনার খরচ জোগাতে শুরু করেন টিউশনি। পাশাপাশি খণ্ডকালীন একটা চাকরিও খুঁজতে থাকেন। এরই মধ্যে বাবার মৃত্যু। চাপ বাড়ে খায়রুলের।

২০০৮ সালের মাঝামাঝিতে খায়রুল ফ্রিল্যান্সার ডটকমে কাজ করার কথা ভাবেন। কিন্তু কম্পিউটার নেই। ৮ হাজার টাকা ধার করে কেনেন পুরোনো কম্পিউটার। এ দিয়ে শুরু। ডাটা এন্ট্রি করে চার দিনে আয় হয় ২০০ ডলার। কিন্তু পেমেন্ট পাননি। ফিল্যান্সার ছেড়ে খায়রুল কাজের সন্ধান করেন ওডেক্সে। প্রতি ঘণ্টায় আয় ২৫ সেন্ট।

এভাবে ১৪ হাজার টাকা আয় করে কম্পিউটারের সক্ষমতা বাড়ান খায়রুল। তখন খায়রুলের দৈনন্দিন রুটিন ছিল, সকাল ৯টা থেকে বেলা ২টা ক্যাম্পাস। বিকেল ৫টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত টিউশনি। তারপর রাত জেগে ফ্রিল্যান্সিং। এরপর ফ্রিল্যান্সিংটা ঠিকঠাক বুঝে নিয়ে টিউশনি ছেড়ে দেন। এভাবে বিবিএ শেষ হয়।

২০১২ সালে খায়রুল যোগ দেন পিএইচপি গ্রুপে। তখনো রাত জেগে চলত ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজ। পাশাপাশি এমবিএর পড়াশোনাও। এ সময় বরিশালে বদলির আদেশ হলে পিএইচপি ছেড়ে ২০১৩ সালের শেষের দিকে যোগ দেন নিটল মোটরসে। অফিসে যাওয়ার জন্য ঘুম থেকে উঠতে হতো সকাল সাড়ে ৬টায়। ফিরতেন সন্ধ্যায়। আবার রাত ৩টা পর্যন্ত ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজ। ঘুমের স্বল্পতা দূর করতে অফিসে যাতায়াতের পথে বাসেই একটু ঘুমিয়ে নিতেন।

এভাবে কেটে যায় প্রায় তিন বছর। ঢাকায় থেকেও এত দিনে এলাকার কিছু তরুণকে ফ্রিল্যান্সিং বুঝিয়ে দিয়েছেন খায়রুল। এবার চাকরি ছাড়ার সাহস করলেন তিনি। সেটা ২০১৮ সালের শুরুর দিক। রাজশাহীতে প্রতিষ্ঠা করলেন ফ্লিট বাংলাদেশ। এত দিন চাকরি আর ফ্রিল্যান্সিং করে যা সঞ্চয় করেছিলেন, তার সবই বিনিয়োগ করলেন সেখানে। রাজশাহীতে প্রযুক্তির বিকাশের সম্ভাবনা সামনে রেখে যাত্রা শুরু করল ফ্লিট বাংলাদেশ।

ফ্লিটের কর্মী

ফ্লিট বাংলাদেশ কাজ শুরু করে ১০ জন ডেভেলপারকে নিয়ে। এখন সব মিলিয়ে ৬০০ জন কাজ করেন ফ্লিটে। এর মধ্যে ১৫০ জন স্থায়ী। অন্যরা খণ্ডকালীন। যে যেমন কাজ করেন, তিনি তেমন অর্থ পান। প্রত্যেকেই স্বাবলম্বী। কর্মীদের জন্য বেতনের বাইরে আছে উৎসব ভাতা, বার্ষিক বোনাস, বিভিন্ন সময় দেশ-বিদেশে যাওয়ার সুযোগ। কর্মীর বাবা-মায়ের হজে যাওয়ারও ব্যবস্থা করে ফ্লিট। আর প্রতিদিনের ‘অফিস স্ট্রেস’ কাটাতে ফ্লিটের অফিসেই আছে গানের আড্ডার সুযোগ, আছে খেলাধুলার ব্যবস্থা।

কী কাজ করে ফ্লিট

ফ্লিট বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর এ পর্যন্ত দেশে কোনো কাজ করা হয়নি। বিদেশে তিন শতাধিক গ্রাহক তাদের। এই তালিকায় আছে আমাজন, ই-বে, ওয়ালমার্টের মতো বিশ্বখ্যাত সব প্রতিষ্ঠান। আমাজনের ভেন্ডর ম্যানেজমেন্ট, ফুলফিলমেন্ট বাই আমাজন, আমাজন প্রাইভেট লেভেল প্রোডাক্ট, ওয়ালমার্টের স্টোর ম্যানেজমেন্ট এবং ই-বের স্টোর ম্যানেজমেন্টের কাজ করে ফ্লিট বাংলাদেশ। এর বাইরেও ফ্লিটের তৈরি করা বিভিন্ন অ্যাপস ও সফটওয়্যার ব্যবহার হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের অনেক দেশে। এবার দেশে কাজে নামবে তারা। আপাতত চারটি বিষয়ে কাজ করবে। এগুলো হলো ফিক্স, ফ্লেক্স, ফ্লিপ বাই ডটকম এবং ফ্লিপ সফট। এর মধ্যে ফিক্স দক্ষ মানুষের জন্য তৈরি করবে চাকরির বাজার। ফ্লেক্স প্রযুক্তি কাজ করবে ফেস ডিটেকশনের।

ফ্লিপ সফট সিটি করপোরেশনের নাগরিক সেবাকে করবে প্রযুক্তিনির্ভর। অত্যাধুনিক এই প্রযুক্তি দেশে প্রথম চালু করবে ফ্লিট। আর ফ্লিপবাই ডটকম হলো একটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান। রাজশাহী থেকে এর যাত্রা শুরু হবে অচিরেই। ফ্লিট বলছে, ই-কমার্স নিয়ে দেশের ভেতর সমস্যা হয়েছে। আসল ই-কমার্সটা তারা দেখাতে চায়। গত মঙ্গলবার বিকেলে ফ্লিট বাংলাদেশের তৃতীয় বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানে রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন নতুন এ চারটি শাখার উদ্বোধন ঘোষণা করেন।

মনের জোরেই জয়

রাজশাহী শহরে হাতছানি ছিল বঙ্গবন্ধু হাইটেক পার্ক। সেটিকে সামনে রেখেই সাহস পেয়েছিলেন খায়রুল। কিন্তু গতিহীন ইন্টারনেট আর বিদ্যুৎ-বিভ্রাট ভাবিয়েছে তাঁকে। তারপরও সাহস নিয়েই তিনি যাত্রাটা শুরু করেন। এখন বিদ্যুতের বিভ্রাট কমেছে, ইন্টারনেটেও গতি বেড়েছে। মান ধরে রেখে কাজ করে যাওয়ায় খুশি ফ্লিটের গ্রাহকেরা। কাজে খুশি হয়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে গ্রাহকেরা রাজশাহীতে খায়রুলের প্রতিষ্ঠানে ঘুরে গেছেন।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

গত বুধবার বিকেলে ফ্লিট বাংলাদেশের প্রধান কার্যালয়ে বসে খায়রুল বলছিলেন, ‘ফ্লিট বাংলাদেশের শুরুতে সব বিনিয়োগ করে দেওয়ার পর পরিস্থিতি এমন, আমি আমার বাচ্চার দুধ কিনতে পারছিলাম না। ঠিক তখনই একজন ক্লায়েন্ট কাজ দিয়ে ২ হাজার ডলার অগ্রিম দিলেন। এভাবেই ফ্লিট বাংলাদেশের শুরু। পরিশ্রম আর চেষ্টার সমন্বয়ে পরিধিটা বড় হলো।’ খায়রুল জানালেন, ২০২৩ সালের মধ্যে আরও ২ হাজার কর্মী বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে তাঁর। সে লক্ষ্যেই তিনি কাজ করে যাচ্ছেন।

ইউকে/এএস