নিজস্ব প্রতিবেদক: এক লাফেই তাপমাত্রা বাড়ছে। আবার এক লাফেই কমছে। মাঘের শেষে শীতবুড়ী যেন যাই যাই করেও যাচ্ছে না! আড়মোড়া দিয়ে আবারও যেন জাপটে ধরতে চাইছে। আবহাওয়ার এমন আচরণে ছন্দপতন ঘটেছে প্রকৃতির। তাই বলে বিদায়ের আনুষ্ঠানিকতার জন্য বসে নেই কেউই। বাংলা পঞ্জিকার অমোঘ নিয়মে দিনের হিসাব যা-ই হোক; প্রকৃতিতে যেন ঋতুরাজ বসন্তের অভিষেক ঘটে গেছে। এই মাঘেই লেগেছে ফাগুনের আগুন। অগ্নিঝরা ফাগুনের আবহনে এরই মধ্যে ফুটেছে শিমুল, ফুটেছে পলাশ। সবুজ আম্রকাননে ঝিলিক দিচ্ছে স্বর্ণালি মুকুল।
কখনও কখনও দূর সীমানা থেকে কানে ভেসে আসছে কোকিলের কুহু কুহু কলতান। আগুন রাঙা গাঁদা ফুলের সঙ্গে মিষ্টি সৌরভ ছড়াচ্ছে আমের মুকুলও। সূর্যের আলো গায়ে পড়তেই আম গাছের সবুজ-শ্যামল পাতাগুলো চিকচিক করে উঠছে। দখিনা বাতাস যখন বইছে আম গাছের শাখা-প্রশাখা আর ডালপালায় তখন দোল খাচ্ছে সোনাঝরা মুকুল। আর মুকুল ঘ্রাণে এখনই মৌ মৌ করতে শুরু করেছে চারিদিক। মুকুলের চারপাশে তাই এখন চলছে মৌমাছিদের গুঞ্জরন।
প্রকৃতির এমন পালাবদল দেখে আন্দোলিত হয়ে উঠছে মানুষের মন। বছর ঘুরে ঋতু বৈচিত্রে আমের শহর রাজশাহীর সবুজ প্রকৃতির আমেজ এখন অনেকটা এমনই আবেগের হয়ে উঠেছে। বলা হয়- বসন্তের ফাগুন আর আমের মুকুল যেন একই সুতোয় গাঁথা। যদিও কাগজে-কলমে এখন বসন্ত উৎসবের ৪/৫ দিন বাকি।
এর পরও বছরের নির্দিষ্ট এই সময়জুড়ে রাজশাহীর আমচাষি ও ব্যবসায়ীসহ কমবেশি সব শ্রেণির মানুষেরই নজর আম বাগানের দিকে। আমের সবুজ পাতা আর মুকুলে এখন দোল খাচ্ছে কৃষকের রঙিন স্বপ্নও। আর সদ্য মুকুল ফোটার এমন দৃশ্য এখন কংক্রিটের শহর থেকে শুরু করে বিস্তৃত রাজশাহীর গ্রামীণ জনপদেও।
রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, নাটোর, পাবনা, বগুড়া ও জয়পুরহাট জেলার প্রায় সব এলাকাতেই এখন প্রচুর আমবাগান রয়েছে। যতোই দিন যাচ্ছে ততই নতুন নতুন জাত উদ্ভাবন হচ্ছে। সেসব জাতের আমের বাগানও তৈরী হচ্ছে। অল্প সময়ের মধ্যে মিলছে আমের ফলনও।
দেশের অর্থনীতিতে আম লাভজনক মৌসুমি ফল ব্যবসা। তাই প্রতি বছরই বাগানের সংখ্যা বাড়ছে। তবে গড়ে ওঠা নতুন আমবাগানগুলোর প্রায়ই বনেদি জাতের। বিশেষ করে নিয়মিত জাত ল্যাংড়া, গোপালভোগ, ক্ষিরসাপাত ও আশ্বিনা জাতের হাইব্রিড গাছই বেশি হচ্ছে।
সাধারণত মাঘের শেষেই রাজশাহীর আম গাছে মুকুল আসে। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। আগে রাজশাহীতে আমের মৌসুমে ‘অফ ইয়ার’ এবং ‘অন ইয়ার’ থাকতো। অফ ইয়ারে ফলন কম হতো আর অন ইয়ারে বেশি হত। কিন্তু প্রায় এক যুগের বেশি সময় থেকে রাজশাহীর গবেষক ও আম চাষিদের অক্লান্ত পরিশ্রমে এই রেওয়াজ ভেঙেছে।বছরজুড়ে চাষিদের নিয়মিত পরিচর্যার কারণে এখন রাজশাহীর সব বাগানেই প্রতিবছরই আমের আশানুরূপ ফলন হচ্ছে এবং বাড়ছেও।
এছাড়া এবার পৌষের শেষেও রাজশাহীর অনেক আম বাগানে আগাম মুকুল এসেছে। তাই এরই মধ্যে স্বর্ণালি মুকুলে ছেয়ে গেছে রাজশাহীর বিভিন্ন এলাকার আম বাগান। গাছজুড়ে মুকুলের আধিপত্যে থাকা বাগানগুলো দেখে তাই আমচাষিদের মনে আশার প্রদীপ জ্বলছে। কারণ আমের মুকুল ও কৃষকের স্বপ্ন একই সুতোয় গাঁথা।
প্রতিদিনই চলছে পরিচর্যা। আমগাছের গোড়ায় মাটি দিয়ে উঁচু করে দেওয়া হচ্ছে সেচ। গেল বছর আমপানে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল রাজশাহীর আম চাষিদের। এবার সেই ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার জন্য শুরু থেকেই প্রাণপণ চেষ্টা করছেন সবাই। আর পরিবেশ ও প্রতিবেশ যেনো আসছে মৌসুমের আম উৎসবেরই জানান দিচ্ছে।
বর্তমানে শহরের পুলিশ লাইন, ভেড়িপাড়া, ছোটবনগ্রাম, বড়বনগ্রাম, গৌরহাঙ্গা, শিরোইল, মালোপাড়া, মেহেরচণ্ডী ও ভদ্রা আবাসিক এলাকা ঘুরে বেশ কিছু আম গাছে প্রচুর মুকুল দেখা যাচ্ছে। সোনারাঙা এই আম্রমুকুলের সৌরভ ছড়িয়ে পড়েছে রাজশাহীর আকাশে-বাতাসে।
তবে মুকুল দেখে আমচাষীরা খুশি হলেও বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তারা বলছেন, পুরোপুরিভাবে শীত বিদায়ের আগেই আমের মুকুল আসা ভালো খুব একটা নয়। মাঝে-মধ্যেই ঘন কুয়াশা থাকছে প্রকৃতিতে। আর এমন হঠাৎ-হঠাৎ ঘন কুয়াশা আমগাছের মুকুলের কাল। এতেই ক্ষতিগ্রস্ত হবে মুকুল। যা পরে ফলনেও প্রভাব ফেলবে।
যদিও প্রাকৃতিক নিয়মে ফাগুন মাসে ঘন কুয়াশার আশঙ্কা খুবই কম। এর পরও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রকৃতি বিরূপ আচরণ করলে আমের মুকুল ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন তারা। মাঝে মধ্যে ঘনকুয়াশা পড়লেও মুকুলের ক্ষতি হবে। পাউডারি মিলডিউ রোগে আক্রান্ত হয়ে এসব মুকুলের অধিকাংশই ঝরে যাবে। ফলে আক্রান্ত বাগান মালিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। তাই শেষ পর্যন্ত না দেখে বলা খুবই কঠিন যে, কী হবে।
মহানগরীর বড়বনগ্রাম এলাকার আম ব্যবসায়ী ফরিদ উদ্দিন। তিনি বলেন, প্রতিবছর এই আম বিক্রি করেই রাজশাহীর অনেক চাষি ঋণের টাকা পরিশোধ করেন, মেয়ের বিয়ে দেন, নিজের চিকিৎসা খরচ জোগাড় করেন, সুদ-আসল দিয়ে জমির কাগজ ছাড়ান। তাই গাছ, মুকুল আর আম অনেকেরই বেঁচে থাকার মূল অবলম্বন। একবার ফলন হলেও তাই বছরের প্রায় পুরোটা সময়টা জুড়েই আম বাগানের পরিচর্যায় তাদের সময় চলে যায়। মাঘের শেষে ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময়ে আমের মুকুল আসে। তবে এবার প্রায় আগেই আমের গাছে মুকুলএসেছে। এখন ঘন কুয়াশাচ্ছন্ন আবহাওয়া না হলেই ভালো হয় বলে জানান- আম ব্যবসায়ী ফরিদ উদ্দিন।
রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আলীম উদ্দিন বলেন, মাঘের শুরুতে শীতের তীব্রতা ছিল। এরই মধ্যে অনেক গাছে মুকুল চলে এসেছে। এখন কোনো কারণে যদি ঘন কুয়াশা স্থায়ী হয় তাহলে আমের মুকুল ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
কিন্তু আবহাওয়া যদি রৌদ্রজ্জ্বল হয় এবং তাপমাত্রা একটু একটু করে বাড়তে থাকে তবে সমস্যা হবে হবে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
ইউকে/এসএম