বিশেষ প্রতিবেদক: মসলিন; এক ধরনের মিহি সুতিবস্ত্র। মসলিন মূলত ‘ঢাকাই মসলিন’ নামে বিশ্বব্যাপী সুপরিচিত। ফুটি কার্পাস তুলা থেকে উৎপন্ন অতি চিকন সুতা দিয়ে তৈরি হয় এই মসলিন। ১৮৫০ সালে লন্ডনে প্রদর্শনের ১৭০ বছর পর বাংলাদেশে বোনা হয়েছে ঐতিহ্যবাহী মসলিন শাড়ি।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক অধ্যাপক মো. মনজুর হোসেনের নেতৃত্বে ১৭০ বছর পর ঐতিহ্য ফিরে পেয়েছে ঢাকাই মসলিন। তার নেতৃত্বে দেশের ৫টি প্রতিষ্ঠানের একদল গবেষকের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় শেষ পর্যন্ত সেই মসলিনের আদলে তৈরি হয়েছে এই মসলিন শাড়ি।
এরমধ্যে দিয়ে তার অনেক সফলতায় যুক্ত হয়েছে আরও একটি সাফল্যের পালক। তার হাত ধরে চলা দীর্ঘ গবেষণা শেষে হারানো ‘ঢাকাই মসলিন’ এখন বাংলাদেশেরই। গবেষকদের দীর্ঘ ছয় বছরের প্রচেষ্টায় মিলেছে ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্যের স্বীকৃতি। গত ২৮ ডিসেম্বর ঢাকাই মসলিনকে বাংলাদেশের ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য স্বীকৃতি দিয়ে গেজেট প্রকাশিত হয়েছে। তাই বহু বছর পর হলেও শিগগিরই মসলিনের যুগে শুভ সূচনা করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
গবেষকরা দীর্ঘ ছয় বছরের প্রচেষ্টায় আবারও মসলিন বুনতে সফল হয়েছেন। এরপরই মিলেছে স্বীকৃতি। সব কিছু ঠিক থাকলে কিছুদিনের মধ্যে প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ের কাজ শেষ হবে। মার্চের পর দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ শুরু হবে। আর প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়টা হবে বাণিজ্যিকভাবে ‘ঢাকাই মসলিনের’ উৎপাদন শুরু করা। তাই বলা যায় ফের সফলতার চূড়ায় উঠেবে ঢাকাই মসলিন। এরইমধ্যে সংশ্লিষ্টরা গাজীপুরের কাপাশিয়ায় শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে এ কাপড় তৈরির বাণিজ্যিক কারখানা নির্মাণের চিন্তাভাবনা করছেন। গবেষণায় সফলতা আসায় এবার বাণিজ্যিক উৎপাদনে যাচ্ছে এই বিখ্যাত কাপড়।
বিখ্যাত কেন? কারণ এক সময় বিশ্বজোড়া খ্যাতিই ছিল ঢাকাই মসলিনের। কালান্তরে এমন গল্পও আছে যে, ৫০ মিটার দীর্ঘ মসলিনের কাপড়কে একটি দিয়াশলাই বাক্সে ভরে রাখা যেত; ১০ গজ দৈর্ঘ্য, ১ গজ প্রস্থের একটি মসলিন কাপড় ছোট্ট একটা আংটির মধ্য দিয়ে আনা-নেওয়া করা যেত; এর ওজন ছিল মাত্র ৬-৭ তোলা! কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যবাহী এই ঢাকাই মসলিনের তাই পুনর্জন্ম ঘটেছে।
এর আগে ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ঢাকাই মসলিন তৈরির প্রযুক্তি ও পুনরুদ্ধার প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। পুরো প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয় ১৪ কোটির কিছু বেশি টাকা। প্রকল্পে সবচেয়ে কঠিন ধাপ ছিলো মসলিনের কাচামাল ফুর্টি কার্পাস জাতের তুলা গাছের সন্ধান পাওয়া।
ইতিহাস বিশ্লেষণ করে অনেক অনুসন্ধানের পর ২০১৭ সালে ঢাকার গাজীপুরের কাপাশিয়ার প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল থেকে মেলে ফুর্টি কার্পাস জাতের তুলা গাছ। খবর পেয়ে গবেষকরা গিয়ে তুলার ধরণ দেখে নিশ্চিত হন, এদিয়ে মসলিন কাপড় তৈরি করা সম্ভব। এরপর সুতা কাটার জন্য নতুন করে তৈরি চরকা দিয়ে বিদেশ থেকে আমদানি করা সুতায় ৪০ তাঁতির মসলিন তৈরির প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় দুই বছর। আর তাঁতপিট লুম চালানের প্রশিক্ষণ দেওয়া ছয় জনকে। প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের মধ্যে এই ছয়জন তাঁতি দিয়ে কুমিল্লার চান্দিনায় ৩০০ থেকে ৪৫০ কাউন্টের সুতা বানানো হয়।
সেই সুতা দিয়ে সোনারগাঁওয়ে বানানো হয় মসলিন কাপড়। প্রায় ৩০০ বছর পর সেই সুতা দিয়ে তৈরি করা যায় মোট ছয়টি শাড়ি। যার মধ্যে একটি প্রধানমন্ত্রীকে উপহার হিসেবে দেওয়া হয়।
গবেষক ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, মসলিনের কাপড় দেখতে ও সুতা সংগ্রহ করতে লন্ডনের ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড আলবার্ট মিউজিয়াম ভ্রমণ করেন একদল গবেষক। এছাড়া বাংলাদেশের কোন কোন এলাকায় মসলিন সুতা তৈরি হতো, তা জেনে সে প্রযুক্তি উদ্ধারেরও চেষ্টা চলতে থাকে। এই লক্ষ্যে বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের চেয়ারম্যানকে আহ্বায়ক করে সাত সদস্যের একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়।
পরে গবেষণাকাজের স্বার্থে আরও সাত সদস্যকে এই কমিটিতে সংযুক্ত করা হয়। তবে কাজের শুরুতে মসলিন কাপড় বা তুলার কোনো নমুনাই গবেষদের কাছে ছিল না। তাদের প্রথম কাজ ছিল- তুলা থেকে সুতা কেটে মসলিন শাড়ি বোনা হতো, এমন তুলার গাছ খুঁজে বের করা।
এই কাজ শেষ করার জন্য ‘বাংলাদেশের সোনালি ঐতিহ্য মসলিন সুতা তৈরির প্রযুক্তি ও মসলিন কাপড় পুনরুদ্ধার (প্রথম পর্যায়)’ শীর্ষক একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। প্রকল্পের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা করা হয়- রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক মো. মনজুর হোসেনকে। আর বাংলাদেশে তাঁত বোর্ডের প্রধান পরিকল্পনা কর্মকর্তা মো. আয়ুব আলী প্রকল্প পরিচালক হিসেবে নিযুক্ত হন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক মো. মনজুর হোসেন জানান, প্রায় দুই বছর আগে মসলিনের পাঁচটি নমুনা দিয়ে জিআই স্বীকৃতির জন্য আবেদন করে বাংলাদেশ। বেশ কয়েকমাস আগে স্বীকৃতি পেলেও গেল ২৮ ডিসেম্বর ঢাকাই মসলিনকে বাংলাদেশের ভৌগলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে গেজেট প্রকাশ হয়। এতে করে মসলিনের উৎপত্তি, বুনন পদ্ধতি ও সুতা সম্পূর্ন বাংলাদেশের তা আর্ন্তজাতিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। যার ফলে এখন থেকে সারা বিশ্বে মসলিন নামে আর কেউ কোনো পণ্য তৈরি করতে পারবে না।
অধ্যাপক এম মনজুর হোসেন আরও বলেন, প্রথম প্রকল্পের কাজ প্রায় শেষ। দ্বিতীয় প্রকল্পের কাজ শিগগিরই শুরু হবে। তখন সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে বাংলাদেশে আবারও ঐহিত্যবাহী ‘ঢাকাই মসলিন’র বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হবে। এতে করে বাংলাদেশ আবারও নতুন করে মসলিনের স্বর্ণালি অধ্যায়ে পা রাখার এক অপার সম্ভাবনার কথা জানান- মসলিনের এই মুখ্য গবেষক।
ইউকে/এসই/এসএম