ফেসবুক শিশুদের ক্ষতি করছে উসকে দিচ্ছে বিভাজন

তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগ: প্রায় ছয় ঘণ্টা ইনস্টাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপসহ ফেসবুকের মালিকানাধীন সব সেবা বন্ধ থাকায় বিশাল বিপর্যয় ও বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির পর এই প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মার্ক জাকারবার্গ নতুন করে সমালোচনার মুখে পড়েছেন।

ফেসবুক ও সংশ্লিষ্ট অ্যাপগুলো শিশুদের মধ্যে বিভেদ বাড়াচ্ছে এবং গণতন্ত্রকে দুর্বল করে দিচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন ফেসবুকের সাবেক প্রডাক্ট ম্যানেজার ফ্রান্সেস হাউগেন। যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটের একটি কমিটির কাছে দেওয়া বক্তব্যে গত মঙ্গলবার ফেসবুকের নানা অসংগতির কথা তুলে ধরেন ৩৭ বছর বয়সী ওই সাবেক কর্মী। তিনি বলেছেন, ফেসবুকের সিইও মার্ক জাকারবার্গ শুধু মুনাফার দিকেই নজর দিচ্ছেন। ফলে প্ল্যাটফর্মটি শিশুদের ভয়ানক ক্ষতি করার পাশাপাশি বিভাজনকেও উসকে দিচ্ছে। ছড়াচ্ছে ভুল তথ্য। মার্কিন আইন প্রণেতাদের ফেসবুকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আরজি জানান তিনি।

ফেসবুক ও এর অধীন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোকে কিভাবে নিরাপদ করা যেতে পারে সে বিষয়েও সুচিন্তিত মত দেন হাউগেন।

নিজের অভিযোগ পোক্ত করতে হাউগেন কয়েক হাজার পৃষ্ঠার অভ্যন্তরীণ গবেষণার দলিলপত্র তুলে ধরেন। ফেসবুকের সিভিক ইন্টিগ্রিটি ইউনিটের চাকরি ছাড়ার আগে তিনি সেগুলো গোপনে কপি করেছিলেন।

সিনেট কমিটির ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান উভয় পক্ষের আইন প্রণেতারা ফেসবুকের বিভিন্ন বিষয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। ডেমোক্র্যাট সিনেটর এবং শুনানির আয়োজনকারী উপকমিটির সভাপতি রিচার্ড ব্লুমেন্টাল বলেন, ‘ফেসবুক জানে তাদের পণ্যগুলো সিগারেটের মতো আসক্তি সৃষ্টি করে। আমাদের শিশুরাই এর শিকার হচ্ছে।’

তিনি জাকারবার্গকে কমিটির সামনে এবং সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন ও ফেডারেল ট্রেড কমিশনের কাছে কম্পানির তদন্তের আহ্বান জানান।

তবে ফেসবুক প্রধানের বক্তব্য, হাউগেনের অভিযোগের বিষয়ে তাঁরা একমত নন। ভুল তথ্য বা ক্ষতিকর কনটেন্ট যাতে না থাকে সে জন্য তাঁরা সব সময় সচেষ্ট।

ফেসবুক বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম। প্রতিষ্ঠানটির তথ্য অনুযায়ী মাসে তাদের ২৭০ কোটি নিয়মিত ব্যবহারকারী রয়েছে। লাখ লাখ মানুষ এই প্রতিষ্ঠানের যোগাযোগ বা ফাইল শেয়ারিং মাধ্যম হোয়াটসঅ্যাপ ও ইনস্টাগ্রামও ব্যবহার করে।

অনেক আগে থেকেই ফেসবুকের বিরুদ্ধে ব্যবহারকারীদের গোপনীয়তা রক্ষা করতে না পারা এবং ভুয়া, উসকানি ও বিভেদমূলক তথ্য ও বক্তব্য ছড়ানো বন্ধে যথেষ্ট ব্যবস্থা না নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের উভয় প্রধান রাজনৈতিক দলের সিনেটররা বলছেন, ফেসবুকের পরিবর্তন দরকার।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী সংবাদপত্র ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের এক খবরে সম্প্রতি বলা হয়, ইনস্টাগ্রামের নিজেদেরই এক গবেষণায় উঠে এসেছে যে এই মাধ্যমটি শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি করতে পারে।

সিবিএস নিউজকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ফ্রান্সিস হাউগেন বলেছেন, সম্প্রতি তিনি ফেসবুকের বেশ কিছু অভ্যন্তরীণ নথিপত্র ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের কাছে হস্তান্তর করেছেন।

হাউগেন বলেন, ‘ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামের কর্মকর্তারা জানেন, কিভাবে মাধ্যমগুলোকে নিরাপদ করা যায়। কিন্তু তাঁরা কোনো পদক্ষেপ নেবেন না। কারণ তাঁরা জনগণের ভালোর চেয়ে নিজেদের মুনাফার প্রতি বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন।’ মার্ক জাকারবার্গের সমালোচনা করে হাউগেন বলেছেন, ‘তিনি নিজে ছাড়া সেখানে তাঁকে জবাবদিহি করানোর মতো আর কেউ নেই।’

ফেসবুকের একজন মুখপাত্র, কেভিন ম্যাক এলিস্টার বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে ইমেইলে বলেন, কম্পানি তার ব্যবহারকারীদের মুনাফা বাড়ানোর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। এটা বলা ঠিক নয় যে ফাঁস হওয়া অভ্যন্তরীণ গবেষণায় দেখা গেছে যে, কিশোরীদের জন্য ইনস্টাগ্রাম ‘বিষাক্ত’।

ফেসবুকের গ্লোবাল সিকিউরিটি প্রধান অ্যান্টিগোন ডেভিস গত সপ্তাহে একই সিনেট কমিটির সামনে এই সাক্ষ্য দেন যে, ‘আমরা আমাদের প্ল্যাটফর্মে থাকা মানুষের সুরক্ষা সম্পর্কে গভীরভাবে যত্নশীল। আমরা বিষয়টিকে খুব গুরুত্ব সহকারে নিই। ১৩ থেকে ১৭ বছর বয়সীদের জন্য নিরাপদ এবং বয়সের উপযুক্ত অভিজ্ঞতা তৈরির জন্য আমরা একাধিক সুরক্ষা দিয়েছি।’

এদিকে ফ্রাসিন্স হাউগেনের নাম উল্লেখ না করে জাকারবার্গ তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ খণ্ডনে গতকাল বুধবার ফেসবুকে দীর্ঘ এক স্ট্যাটাস দিয়েছেন। এতে তিনি বলেন, অভিযোগগুলোর মূলে এই ধারণাটি রয়েছে যে আমরা নিরাপত্তা এবং কল্যাণের চেয়ে মুনাফাকে অগ্রাধিকার দিই। এটা ঠিক নয়।’ ফেসবুক প্রধান দাবি করেন, যোগাযোগ মাধ্যমটির কাজ ও উদ্দেশ্যকে ভুলভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। ফেসবুক সব সময়ই নিরাপত্তা, কল্যাণ ও মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়ে গুরুত্ব দেয়।

জাকারবার্গ আরো বলেন, ‘বাস্তবতা হচ্ছে—তরুণরা প্রযুক্তি ব্যবহার করে। স্কুল বয়সের ছেলেমেয়েদের কাছে কত ফোন আছে তা নিয়ে ভাবুন। একে উপেক্ষা করার পরিবর্তে প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠানগুলোর এমন অভিজ্ঞতা তৈরি করা উচিত, যা কিশোরদের চাহিদা পূরণ করার পাশাপাশি তাদের সুরক্ষিত রাখে। আমরা এ নিয়ে ভালো কাজের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য গভীরভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’

জাকারবার্গ অবশ্য ইন্টারনেটের ওপর নিয়ন্ত্রণের বিধি-বিধানের বিষয়টি হালনাগাদ করার প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে দৃশ্যত হাউগেনের সঙ্গে একমত। তিনি বলেন, এটা হলে কম্পানিগুলোর ওপর থেকে সামাজিক বিষয়ে নিজে থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার চাপ কমবে।

আইওয়া অঙ্গরাজ্যের বাসিন্দা ফ্রান্সিস হাউগেন কম্পিউটার প্রকৌশলে ডিগ্রি ও হার্ভার্ড থেকে ব্যবসা বিষয়ে স্নাতকোত্তর করা ডাটা বিশেষজ্ঞ। ২০১৯ সালে ফেসবুকে যোগ দেওয়ার আগে তিনি ১৫ বছর ধরে গুগল, পিন্টারেস্ট, ইয়েলপসহ বিভিন্ন প্রযুক্তি কম্পানিতে কাজ করেছেন।

ইউকে/এএস