বঙ্গবন্ধু টানেলের দ্বিতীয় সুড়ঙ্গের খননকাজ শেষ

বার্তাকক্ষ প্রতিবেদন: চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মাণাধীন টানেলের দ্বিতীয় সুড়ঙ্গের খননকাজ শেষ হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে এই কাজ শেষ হয়। চলতি বছরের ডিসেম্বর মাসে কাজটি শেষ করার লক্ষ্য ছিল, কিন্তু ১০ মাসেই কাজ শেষ হয়েছে।

দ্বিতীয় সুড়ঙ্গের খননকাজ হওয়ায় বহুপ্রতীক্ষিত এই টানেল চালুর পথে আরো এক ধাপ এগিয়ে গেল। কারণ দুটি সুড়ঙ্গ খনন শেষ হওয়ার মাধ্যমে প্রকল্পের সবচেয়ে জটিল কাজটি সম্পন্ন হলো। এখন বাকি আছে শুধু সড়ক তৈরি ও অন্যান্য কাজ।

২০২২ সালের ডিসেম্বরে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে, কিন্তু তার আগেই কাজ শেষ করে টানেল চালুর আশা করা হচ্ছে। প্রকল্পসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এখন যে গতিতে কাজ হচ্ছে সেটা অব্যাহত থাকলে প্রকল্পের কাজ আগেভাগে শেষ করা সম্ভব।

পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান গত মঙ্গলবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভা শেষে সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, দ্বিতীয় সুড়ঙ্গের খননকাজ শুক্রবার রাতে সম্পন্ন হবে। এ ছাড়া নির্ধারিত সময়ের আগেই টানেল প্রকল্পটির কাজ শেষ হবে বলে তিনি জানান।

এ টানেল চালু হলে চট্টগ্রামে পরিবহনব্যবস্থার উন্নয়ন এবং বাংলাদেশের আঞ্চলিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন বেগবান হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে ঢাকা-চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের মধ্যে আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে ওঠার পাশাপাশি এশিয়ান হাইওয়ের সঙ্গেও সংযোগ স্থাপিত হবে। টানেলটি চালু হলে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা কক্সবাজার ও দক্ষিণ চট্টগ্রামগামী যানবাহনকে আর চট্টগ্রাম শহরে ঢুকতে হবে না; সিটি আউটার রিং রোড হয়ে এই সুড়ঙ্গপথে দ্রুততম সময়ের মধ্যে গন্তব্যে পৌঁছতে পারবে। এতে চট্টগ্রাম শহর যানবাহনের চাপ থেকে কিছুটা হলেও রেহাই পাবে। যদিও প্রকল্পটির বড় ভূমিকা দেখা যাবে কক্সবাজারের মহেশখালীতে গভীর সমুদ্রবন্দর ও অর্থনৈতিক অঞ্চল চালু হওয়ার পর।

অবশ্য যান চলাচল কবে নাগাদ শুরু হবে, সে বিষয়ে প্রকল্পসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এটা সরকারের সিদ্ধান্ত। আগামী বছর আরো কয়েকটি বড় প্রকল্প চালু হতে যাচ্ছে। এসব প্রকল্পের তালিকায় কর্ণফুলী টানেলও রয়েছে।

চট্টগ্রাম নগরকে কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ প্রান্তে আনোয়ারা উপজেলার সঙ্গে যুক্ত করবে এই টানেল। টানেল নির্মাণের জন্য চীনের সঙ্গে চুক্তি হয় ২০১৫ সালের ২৪ নভেম্বর। এর আগে ২০১৪ সালে প্রকল্প বাস্তবায়নে বাংলাদেশ ও চীনের সরকারি পর্যায়ে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। আর চীন সরকার এই টানেল নির্মাণের জন্য সে দেশের প্রতিষ্ঠান চায়না কমিউনিকেশন অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন কম্পানি (সিসিসিসি) লিমিটেডকে নিয়োগ করে। ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি টানেলের নির্মাণকাজ শুরু হয়। উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

টানেলটি নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা। নদীর তলদেশে নির্মাণাধীন দেশের প্রথম টানেলের নামকরণ করা হয়েছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মকর্তা জানান, প্রকল্পের ব্যয় কিছুটা বাড়তে পারে, তবে কত বাড়তে পারে তা কাজের ওপর নির্ভর করছে। প্রথমে প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা।

প্রকল্পটির পরিচালক প্রকৌশলী হারুনুর রশীদ চৌধুরী গতকাল বলেন, প্রথম সুড়ঙ্গ খননে ১৭ মাস সময় লেগেছিল। দ্বিতীয় সুড়ঙ্গ খনন ১০ মাসের মধ্যে শেষ হয়েছে। এরই মধ্যে প্রকল্পের ৭৩ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে, বাকি ২৩ শতাংশ কাজ প্রকল্পের মেয়াদের অনেক আগেই শেষ হতে পারে। প্রকৌশলী হারুনুর রশীদ চৌধুরী বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে পর্যটন, আবাসন ও যোগাযোগব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আসবে।

টানেলের প্রথম সুড়ঙ্গ খননের কাজ নগরের পতেঙ্গা প্রান্ত থেকে শুরু হয়। আর দ্বিতীয় টানেলের কাজ শুরু হয় আনোয়ারা প্রান্ত থেকে।

চট্টগ্রাম নগর প্রান্তের নেভাল একাডেমির পাশ দিয়ে শুরু হওয়া এ সুড়ঙ্গ কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ পারে আনোয়ারার সিইউএফএল (চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেড) ও কাফকো (কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার লিমিটেড) কারখানার মাঝামাঝি এলাকায় গিয়ে শেষ হয়েছে। টানেলের প্রথম ও দ্বিতীয় সুড়ঙ্গের মধ্যে দূরত্ব ১২ মিটার। দুই সুড়ঙ্গে দুটি করে চারটি লেন হবে। নদীর তলদেশের ১৮ মিটার থেকে ৩৪ মিটার গভীরতায় সুড়ঙ্গ খনন করা হয়েছে। ৩.৪ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের মূল টানেল ছাড়াও পতেঙ্গা ও আনোয়ারা প্রান্তে ৫.৩৫ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক এবং আনোয়ারা প্রান্তে ৭২৭ মিটার একটি উড়াল সেতু হচ্ছে।

প্রকল্পসংশ্লিষ্ট কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রথম সুড়ঙ্গ খনন ও রিং বসানোর কাজ শেষ হয় গত বছরের আগস্টে। এরপর ১২ ডিসেম্বর দ্বিতীয় সুড়ঙ্গের খননকাজ উদ্বোধন করেন সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।

গতকাল সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত সরেজমিনে প্রকল্প এলাকায় থেকে দেখা যায়, দ্বিতীয় সুড়ঙ্গ খননের শেষ মুহূর্তের কাজের পাশাপাশি প্রকল্পের অন্যান্য কাজও সমান তালে চলছে। প্রকল্প বাস্তবায়নে নিয়োজিত কর্মকর্তারা কাজে ব্যস্ত। চীনের প্রায় ২৫০ এবং দেশের ৮০০-এর বেশি লোকবল কাজ করছেন। প্রথম সুড়ঙ্গের পাশাপাশি দ্বিতীয় সুড়ঙ্গেও সড়ক নির্মাণ, টানেলের দুই পারের সংযোগ সড়ক, বিদ্যুৎ সংযোগসহ আনুষঙ্গিক কাজ চলছে।

ইউকে/এএস