বার্তাকক্ষ প্রতিবেদন: নির্বাচনে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে ভোট ব্যবস্থাপনায় ২০১০ সালে যুক্ত করা হয় ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম)। নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ভোটযন্ত্রটির জনপ্রিয়তা ভোটারদের মধ্যে বাড়লেও এটি সংরক্ষণের এখনো যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পারেনি নির্বাচন কমিশন (ইসি)।
সম্প্রতি উপজেলা নির্বাচন অফিসে ইভিএম মেশিন উইপোকা, তেলাপোকায় নষ্ট করছে বলে খোদ ইসি কর্মকর্তারাই বৈঠকে জানিয়েছেন। এই বাস্তবতার মাঝেই মাঠ কার্যালয়ের স্টোররুমে মূল্যবান যন্ত্রটি রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
ইসি সচিব মো. হুমায়ুন কবীর খোন্দকারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত গত ২৯ সেপ্টেম্বরের বৈঠকে এমন সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানা গেছে। তার স্বাক্ষরিত বৈঠকের কার্যবিবরণীতে বলা হয়েছে—উপজেলা/থানা নির্বাচন অফিসের স্টোররুমের সক্ষমতা অনুযায়ী প্রতিটি অফিসে ইভিএম সংরক্ষণ করতে হবে। প্রতিটি অফিসে কী পরিমাণ ইভিএম সংরক্ষণ করা সম্ভব, সে বিষয়ে সরেজমিনে তদন্ত করে আগামী ১৫ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য প্রতিটি আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তাকে নির্দেশনাও দিয়েছেন ইসি সচিব।
সঠিক সংরক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় উইপোকা, তেলাপোকা ইভিএম নষ্ট করছে এমন অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। ইভিএম সংরক্ষণের যথাযথ ব্যবস্থা না করার কারণ কী, ইভিএমের প্রকল্প পরিচালক কর্নেল মো. কামাল উদ্দিনের কাছে এমন প্রশ্ন রাখা হলে প্রতিবেদককে তিনি বলেন, বক্তব্যটি সঠিক নয়। ইভিএম প্রকল্পে ইভিএম রক্ষণাবেক্ষণের সুব্যবস্থা আছে। এই প্রকল্পের আওতায় মোট ইভিএম ক্রয় করা হয়েছে ১ লাখ ৫০ হাজার, যা সরবরাহ করেছে বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি (বিএমটিএফ) লিমিটেড। প্রায় ১ লাখ ইভিএম বিএমটিএফ-এর গুদামে সুরক্ষিত অবস্থায় সংরক্ষিত আছে। এবং প্রায় ৫০ হাজার ইভিএম মাঠ পর্যায়ে বিভিন্ন জেলায় নির্বাচন কমিশনের অফিসে রক্ষিত আছে।
সম্প্রতি একটি স্থানে কিছু ইভিএম উইপোকা, তেলাপোকায় নষ্ট করেছে—এমন অভিযোগ আমাদের নজরে এসেছে। এটি সরেজমিনে তদন্ত করা হয়েছে। তদন্ত রিপোর্টে জানা গেছে ইভিএম সরঞ্জামাদির জন্য ব্যবহৃত বেশ কিছু কাগজের প্যাকেট এবং আনুষঙ্গিক সামগ্রীর কিছু তার নষ্ট হয়েছে। ইভিএম মেশিনের কোনো ক্ষতি হয়নি। সম্প্রতি সচিবের সভাপতিত্বে মতবিনিময় সভায় এটি আলোচিত হয়েছে এবং যথাযথ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ইভিএম প্রকল্পের পক্ষ থেকে নিয়মিত মনিটরিং ও তত্ত্বাবধান চলমান আছে।
বর্তমানে ব্যবহৃত ইভিএম যেমন অনেক দামি, তেমনি উন্নতমানের। এ নিয়ে স্বয়ং প্রধান নির্বাচন কমিশনার কমিশনার সিইসি কেএম নূরুল হুদা গণমাধ্যমকে বলেছেন—এই যন্ত্রের মাধ্যমে বাইরে থেকেই ভোট ব্যবস্থাপনায় হস্তক্ষেপের কোনো সুযোগ নেই।
জানা গেছে, চার হাজার কোটি টাকার ইভিএম প্রকল্পে প্রতিটি মেশিনের পেছনে ব্যয় হয়েছে ২ লাখ ১০ হাজার টাকার মতো। কিন্তু এত দামি মেশিন কোথায় রাখা হবে, তার জন্য প্রকল্পতে কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি। ফলে যথাযথ যত্ন ছাড়াই এগুলো স্থান পাচ্ছে মাঠ কর্মকর্তাদের কার্যালয়ে। কেননা, ইভিএমে মেশিন একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রা, আর্দ্রতায় সংরক্ষণ করতে হয়। স্টোররুমে এই ব্যবস্থার কতটা সুযোগ রয়েছে, তা নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে।
২০১৮ সালেই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ৮০ হাজার ইভিএম, প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে বুঝে নিতে চেয়েছিল ইসি। কিন্তু সময় স্বল্পতার কারণে সে সময় সে সংখ্যক ইভিএম তৈরি করা সম্ভব হয়নি। ৩০ ডিসেম্বরের ওই সংসদ নির্বাচনে ৬টি আসনে ৫ হাজারের মতো উন্নতমানের এই ইভিএম দিয়ে ভোট নেওয়া হয়েছিল। বর্তমানে প্রতিটি নির্বাচনেই কম-বেশি হারে এই যন্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে। ইসির পরিকল্পনা ধীরে ধীরে ইভিএমের ব্যবহার বাড়ানো হবে।
২০১০ সালে এটিএম শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন তৎকালীন কমিশন দেশে ভোট ব্যবস্থাপনায় প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে ইভিএমের সূচনা করে। সে সময় বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ থেকে এই ভোটযন্ত্র তৈরি করে নেওয়া হয়েছিল।
কয়েক বছর ভালো ফল পাওয়া গেলেও ২০১৫ সালের রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনের সময় একটি মেশিনে যান্ত্রিক ত্রুটি ধরা পড়ে। সেই মেশিনটি আর সারাতে পারেনি নির্বাচন কমিশন। এমনকি ত্রুটি হওয়ার কারণও উদ্ধার করতে পারেনি।
কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন কমিশন ২০১৬ সালে এমন পরিস্থিতে বুয়েটের তৈরি অল্পদামের মেশিনগুলো পরিত্যাক্ত ঘোষণা করে নষ্ট করে ফেলে। একইসঙ্গে নতুন এবং উন্নতমানে ইভিএম তৈরির নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়। ওই সিদ্ধান্তের ধারাবাহিকতায় বর্তমান কেএম নূরুল হুদা কমিশন আগের চেয়ে প্রায় ২০ গুণ বেশি দামে মেশিনগুলো তৈরি করে নিয়েছে। নতুন ইভিএম দিয়ে ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রথম ভোট নিয়ে সফল হয় নির্বাচন কমিশন।
ইউকে/এএস