নিজস্ব প্রতিবেদক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) থেকে এমবিএ করেছেন ৩০ বছরের এম ওয়াদুদ জিয়া ওরফে জুয়েল। তবে, শিক্ষাজীবনের মেধা ভালো কাজে লাগাননি। দ্রুত হতে চেয়েছেন বিত্তবৈভবের মালিক। নিজের মেধাকে খারাপ কাজে লাগিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রেমের ফাঁদ পাতেন। একে একে ফেসবুকে মোট নয়টি ভুয়া অ্যাকাউন্ট খুলে গড়েন ভার্চ্যুয়াল পরিবার। এতে তিনি নিজেই ঘটক, নিজেই বর এবং নিজেই এই নয় সদস্যের পরিবার। একাই অভিনয় করেছেন সব চরিত্রে।
এভাবে রাজশাহীর এক এতিম নারীর কাছ থেকে কয়েক দফায় হাতিয়ে নিয়েছেন প্রায় ৮ লাখ টাকা। সর্বশেষ নিজের মৃত্যুর নাটক পর্যন্ত মঞ্চস্থ করেছেন। প্রতারণার সেই টাকা দিয়ে গ্রামের বাড়িতে করেছেন গরুর খামার, কিনেছেন জমি। তবে, শেষ রক্ষা হয়নি, পুলিশের হাতে ধরা পড়ে এখন কারাগারে অভিনব প্রতারক জুয়েল।
ওয়াদুদ জিয়া ওরফে জুয়েলের গ্রামের বাড়ি দিনাজপুর জেলার নবাবগঞ্জ থানার বাঘাডোবা ভবানীপুর গ্রামে। তিনি ওই এলাকার জাকারিয়া আনসারীর ছেলে। তবে তাকে রাজশাহী থেকে আটক করা হয়েছে।
বুধবার (১৩ অক্টোবর) দুপুরে রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশ (আরএমপি) সদর দফতরে তার প্রতারণার অভিনব কৌশল জানাতে সংবাদ সম্মেলন করা হয়। এ সময় তার প্রতারণার বিস্তারিত বর্ণানা দেন আরএমপি কমিশনার মো. আবু কালাম সিদ্দিক।
তিনি বলেন- ফেসবুকে নয়টি ফেক আইডি খুলেছিলেন জুয়েল। সেখানে অভিনব কায়দায় এক এতিম নারীকে বিয়ে এবং চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে ৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা আত্মসাৎ করেন। পরে সেই নারীর অভিযোগের ভিত্তিতে মাঠে নামে আরএমপির গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) সদস্যরা।
২০১৯ সালের দিকে সিমা (ছদ্মনাম) এর সঙ্গে আমিনুল ইসলাম নামের এক যুবকের ফেসবুকে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠে। ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে যোগাযোগ হলেও তাদের মধ্যে সাক্ষাৎ হয়নি। পরে ভুক্তভোগী সিমার প্রেমিকের ফেসবুক আইডি হ্যাক করে নিজেই প্রেমিক সেজে সিমার সঙ্গে আমিনুল ইসলাম পরিচয়ে প্রেমের অভিনয় শুরু করেন জুয়েল। তার কিছুদিন পরে জুয়েল আরও একটি ভুয়া ফেসবুক আইডি খুলে নিজেকে সিমার প্রেমিকের ঘনিষ্ঠ বন্ধু পরিচয় দিয়ে পারিবারিকভাবে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে ঘটক সেজে ওই নারীর বাসায় যান।
কারণ হিসেবে জানান- তাকে ভালোবাসলেও পরিবারের সম্মতি ছাড়া বিয়ে করতে পারবে না আমিনুল। এতে সিমার বিশ্বাস আরও বেড়ে যায় তার প্রতি। এরপর সেখানে নিজের ল্যাপটপ হারানোর কথা বলে সিমার মায়ের কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকার চেক নেন। পুনরায় জুয়েল আরেকটি আইডি থেকে সিমাকে মেসেঞ্জারে ‘তোমার প্রেমিক ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে ঢাকায় স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি আছে। তার চিকিৎসার জন্য অনেক টাকা ব্যয় হচ্ছে’- এ কথা বলে তার কাছ থেকে ৩ লাখ টাকা নেন।
টাকা দেওয়ার পর সিমা ও তার পরিবার আমিনুলের সঙ্গে দেখা করতে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হয়। তখন জুয়েল সিমাকে জানায় আমিনুল মারা গেছে, আর আসার প্রয়োজন নেই। তারা মরদেহ নিয়ে আমিনুলের গ্রামের বাড়ি ফিরছেন। এ সময় মোবাইলেই আমিনুলের আত্মীয়-স্বজনের কান্নাকাটি ও আহাজারি শোনানো হয় সিমাকে।
এর কিছুদিন পরে প্রতারক জুয়েল আরও একটি ভুয়া আইডি থেকে আমিনুলের বোন পরিচয় দিয়ে সিমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তার ভাইয়ের চিকিৎসার জন্য তিন লাখ টাকা ব্যয় করার জন্য সিমাকে ধন্যবাদ জানিয়ে টাকা ফেরত দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। পরবর্তীতে জুয়েল আমিনুলের বোন পরিচয়ে সিমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে থাকেন এবং একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দেওয়ার কথা বলেন। আর সেই চাকরির জন্য ৭ লাখ টাকার প্রয়োজন বলে সিমাকে জানান।
বলেন, তিন লাখ টাকা আমিনুলের পরিবারের পক্ষ থেকে দেওয়া হবে, আর অবশিষ্ট চার লাখ টাকা সিমাকে দিতে হবে। তার কথায় বিশ্বাস করে মেয়ের চাকরির আশায় সিমার মা অবশিষ্ট সঞ্চয়ের ৪ লাখ টাকা ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে দেন। সেই টাকা নেওয়ার পর জুয়েল তার ব্যবহৃত তিনটি ফেক আইডি বন্ধ করে সিমার সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।
ব্যবহৃত তিনটি আইডি আলাদা আলাদা নামে হলেও জুয়েল নিজেই তিনটি চরিত্রে অভিনয় করে সিমার সঙ্গে বিভিন্নভাবে প্রতারণা করে এভাবে মোট সাড়ে ৭ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন। পরে ভুক্তভোগীর পরিবার বিষয়টি বুঝতে পেরে আরএমপি কমিশনারের কাছে অভিযোগ করেন। এরপরই মাঠে নামে আরএমপির ডিবি সদস্যরা।
এরপর প্রতারক জুয়েলকে শনাক্ত করা হয়। বুধবার সকালে ডিবি পুলিশের একটি টিম বোয়ালিয়া থানার মকবুল হালদার মোড় এলাকায় অভিযান চালিয়ে প্রতারক তাকে আটক করে।
জিজ্ঞাসাবাদে জুয়েল পুরো ঘটনা খুলে বলেন এবং জানান তার নয়টি ফেক আইডি আছে। আর সিমার কাছ থেকে নেওয়া টাকা দিয়ে নিজ গ্রামে গরুর খামার দিয়েছেন এবং জমিও কিনেছেন। মামলার পর বিকেলে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে জুয়েলকে।
ইউকে/এএস