পদ্মার চরের ‘পাতকুয়া’ এখন কৃষকদের আশীর্বাদ

নিজস্ব প্রতিবেদক: বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রতিনিয়ত পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। এতে দেশের সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছে বরেন্দ্র অঞ্চলের চাষিরা। হাতকল আসার আগে এ অঞ্চলের কৃষি ও সুপেয় পানির নির্ভরযোগ্য আধার ছিল ‘পাতকুয়া’।

তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সাবমার্সিবল পাম্প, গভীর নলকূপসহ নানা প্রযুক্তির কাছে হারিয়ে যায় পাতকুয়া। তবে দীর্ঘদিন পর আবার কৃষি কাজসহ অন্যান্য কাজের জন্য পাতকুয়ার প্রয়োজন অনুভব করছে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের প্রকৌশলীরা।

রাজশাহীর চর মাজারদিয়া এলাকায় ইতোমধ্যে চারটি পাতকুয়া স্থাপন করেছে বিএমডিএ। সৌরবিদ্যুৎ চালিত এসব পাতকুয়ায় পর্যাপ্ত পানিও উঠছে।

পাতকুয়া হলো ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তরের নিচ পর্যন্ত গোলাকার আকৃতিতে মাটি খনন করে চারপাশ থেকে চুয়ানো পানি ধরে রাখার আধার। এসব পানি এলএলপির মাধ্যমে প্রথমে একটি ট্যাংকে তোলা হয়। তারপর সৌর শক্তিকে ব্যবহার করে যন্ত্রের মাধ্যমে সেই পানি যাচ্ছে ঘর-গৃহস্থালী ও কৃষিজমির সেচকাজে। ফলে পাতকুয়ার চারপাশে চরের মাটিতে এখন নির্বিঘ্নে চাষাবাদ করা হচ্ছে নানা রকম সবজি।

কৃষকরা বলছেন, পাতকুয়ার পানি ব্যবহার করতে কোনো টাকা দিতে হয় না। তবে মেশিনের কোনো যন্ত্রাংশ নষ্ট হলে অথবা সমস্যা হলে সেটি ঠিক করার জন্য ঘণ্টা প্রতি ২০ টাকা করে জমা দেওয়া হয়। বিনামূল্যে সেচ সুবিধা পাওয়ার ফলে কৃষকদের চাষাবাদের কাজে খরচও অনেক কম হয়। এতে তারা বিভিন্ন সবজি চাষ করে ভালো লাভবান হচ্ছেন। পাতকুয়া থাকার ফলে তাদের সেচ নিয়েও আর ভাবতে হয় না। এটি তাদের চাষাবাদের জন্য আশীর্বাদ স্বরূপ বলেও মনে করেন অনেক কৃষক।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, গত কয়েক বছরে রাজশাহীর পবা উপজেলার পদ্মা নদীর চরমাজারদিয়া স্কুলমাঠ এলাকা, খাসমালপাড়া, পশ্চিমপাড়া ও পূর্বপাড়ার মাঠে চারটি পাতকুয়া স্থাপন করেছে বিএমডিএ।

প্রতিটি পাতকুয়া স্থাপনে ব্যয় হয়েছে প্রায় ১৪ লাখ টাকা। পাতকুয়ার পানি সরবরাহের হার মূলত নির্ভর করে সূর্যের তাপের ওপর। সূর্যের তাপ ভালো থাকলে সৌরবিদ্যুৎ বেশি হয়। এতে অনেক বেশি পানিও পাওয়া যায়। একদিনের পানিতে প্রায় ১৫-২০ বিঘা জমি সেচ দেওয়া যায়। আরও কিছু পাতকুয়া স্থাপনের জন্য কৃষকদের পক্ষে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করা হয়েছে। সেগুলো পেলে কৃষকরা আরও বেশি লাভবান হবেন।

আরও জানা যায়, চরাঞ্চলে বিদ্যুৎ না থাকায় জ্বালানি তেল পুড়িয়ে শ্যালো ইঞ্জিনের মধ্যেমে পানি উঠাতে অনেক বেশি খরচ হয়। এতে কৃষকদেরও চাষের খরচ অনেক বেড়ে যায়। এক্ষেত্রে পাতকুয়া থেকে চাষিরা বিনামূল্যে পানি পাচ্ছেন। এতে কৃষকরা আগের চেয়ে অনেক বেশি ফসল চাষের দিকে ঝুঁকছেন।

চর মাজারদিয়া পশ্চিমপাড়া এলাকার পাতকুয়ার অপারেটর আবুল কালাম আজাদ বলেন, সূর্য ওঠার পর থেকে আমরা পানি পেতে শুরু করি। সূর্য ডোবার আগ পর্যন্ত পানি পাওয়া যায়। এক ঘণ্টায় প্রায় এক বিঘা জমি ভেজানো সম্ভব হয়। আর পানি নেওয়ার জন্য কোনো ধরনের টাকাও নেওয়া হয় না। তবে পাতকুয়ার বিভিন্ন যন্ত্রাংশ নষ্ট হলে সেটি কেনার জন্য টাকা লাগে। এজন্য সেই হিসেবে মোটর রক্ষণাবেক্ষণ খরচে যোগাতে প্রতি ঘণ্টায় ২০ টাকা করে নেওয়া হয়।

চর মাজারদিয়ার স্কুল মাঠ এলাকার পাতকুয়ার অপারেটর মো. টিয়া। তিনি বলেন, কয়েক বছর আগে চরাঞ্চলে পানির অভাবে অনেক জমিতে চাষ হত না। বর্তমানে পাতকুয়া পাওয়ার পর থেকে জমিতে সব ধরনের চাষ করা সম্ভব হচ্ছে। এতে আমাদের অঞ্চলের কৃষকদের ভাগ্যের ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে।

অন্যদিকে পাতকুয়ার পানি নিতে কোনো খরচ না থাকায় প্রতিনিয়ত এলাকার মানুষদের মাঝে সবজিসহ নানা কিছু চাষের প্রবণতা বাড়ছে। এই পাতকুয়া আমাদের জন্য আশীর্বাদের মত। যোগ করেন এই অপারেটর।

এদিকে পবার চর মাজারদিয়া ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য শেখ শামীম বলেন, পাতকুয়া থেকে পানি নিয়ে সব ধরনের সবজি চাষ করছে চাষিরা। সেচ সুবিধা পাওয়ায় জমি আর কেউ ফেলে রাখে না। ফলনও ভালো হয়। সেচ দিয়ে চাষাবাদ করায় চাষিরা লাভবান হচ্ছেন। অনেকেই স্বাবলম্বী হচ্ছেন। পাতকুয়ার আওতায় প্রতি ৫০ হাত পর পর ট্যাপ বসানো আছে। সেখান থেকে রাবার পাইপ দিয়ে চাষিরা ইচ্ছামত পানি নিয়ে সেচ কাজ চালায়।

তিনি আরও বলেন, আমার ছোট ভাই একটি পাতকুয়ার অপারেটর। সেখানে থেকে এলাকার একটি মাদরাসা ও মসজিদে পানি সরবরাহ করা হয়।

এ প্রকল্পের পরিচালক বিএমডিএর নির্বাহী প্রকৌশলী শিবির আহমেদ বলেন, কয়েক বছর আগেই এই অঞ্চলে পানির অভাবে অনেক জমিতে চাষ হতো না। কিন্তু এখন পানি পর্যাপ্ত থাকায় সব ধরনের চাষ করতে পারছেন। এই অঞ্চলের ৪টি পাতকুয়ার সুফল পাচ্ছেন প্রায় ১০ হাজার মানুষ। নামমাত্র খরচে পানি পাওয়ায় কৃষি বিভিন্ন ফসল ফলাচ্ছেন তারা। অল্প হলেও এটি আমাদের দেশের কৃষিক্ষেত্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আগামীতে আরও বেশি সংখ্যক পাতকুয়া বসানোর পরিকল্পনা আছে।

ইউকে/এসই