বার্তাকক্ষ প্রতিবেদন: রাজধানীর মিরপুর এলাকা থেকে ৪২৪ মেয়ে শিশু-কিশোরী নিখোঁজ হয়েছে। তাদের একটি বড় অংশ মা-বাবার সঙ্গে অভিমান, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পরিচয় ও সম্পর্কের কারণে বন্ধুর সঙ্গে ঘর ছেড়েছে।
তাদের একটি বড় অংশকে পুলিশ উদ্ধার করেছে। অনেকে স্বেচ্ছায় পরিবারের কাছে ফিরেছে। এই সংখ্যা আড়াই শর মতো বলে পুলিশ জানিয়েছে। বাকিদের উদ্ধারের চেষ্টা চলছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের মিরপুর বিভাগের সাতটি থানার গত তিন মাসে হওয়া সাধারণ ডায়েরি (জিডি) থেকে এই তথ্য পাওয়া গেছে। নিখোঁজ শিশু-কিশোরীদের একটি অংশ ছেলে বন্ধুদের সঙ্গে ঘর ছাড়লেও তাদের পরিবারের পক্ষ থেকে জিডি করার ঘটনা নেই বললেই চলে। প্রায় সব জিডিই করেছে শিশু-কিশোরীদের অভিভাবকরা।
গত তিন মাসে শুধু পল্লবী থানা এলাকা থেকেই ১১৪ কিশোরী নিখোঁজ হয়। এর মধ্যে গত জুলাইয়ে ২২, আগস্টে ৪৩ এবং সেপ্টেম্বরে ৪৮ জন নিখোঁজ হয়েছে। এই পল্লবী থানা এলাকা থেকে চলতি মাসের প্রথম ১০ দিনে অন্তত ১৫ কিশোরী বাসা থেকে নিখোঁজ হয়েছে বলে থানায় জিডি করা হয়েছে।
গত ৩০ সেপ্টেম্বর পল্লবী এলাকার তিন তরুণী বাসা থেকে বের হয়ে যায়। তাদের উদ্ধারের পর জানা যায়, মানব পাচারকারী একটি চক্রের খপ্পরে পড়েছিল তারা। তারা জাপান যাওয়ার প্রলোভনে ঘর ছাড়ে। সময়মতো তাদের উদ্ধার করা না গেলে বড় ধরনের বিপদে পড়ত তারা। এর পরপরই আরো পাঁচ শিক্ষার্থী মিরপুর এলাকা থেকে নিখোঁজ হলে গণমাধ্যমে বড় খবর হয়। পরে তারা উদ্ধারও হয়। এর সূত্র ধরে কালের কণ্ঠ মিরপুরের থানাগুলোতে খোঁজ নিয়ে এই চিত্র পায়।
সরেজমিনে গত কয়েক দিন মিরপুর এলাকায় গিয়ে একাধিক অভিভাবক ও পুলিশের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নিখোঁজ হওয়া কিশোরীদের মধ্যে বেশির ভাগ ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী। এদের বড় একটি অংশ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে পরিচিত-অপরিচিত ছেলেদের সঙ্গে বন্ধুত্বে জড়িয়েছে। তারপর ঘর ছেড়েছে। এরা মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান বলে পুলিশ জানিয়েছে।
সম্প্রতি গিয়ে দেখা যায়, অসহায় এক বাবা তাঁর মেয়েকে নিয়ে পল্লবী থানার ওসির সামনে বসে আছেন। গত ৯ অক্টোবর পল্লবী এলাকার বাসা থেকে চলে যায় অষ্টম শ্রেণিতে পড়া মেয়েটি। পরের দিন পরিবার থানায় জিডি করে। তদন্তে নেমে পুলিশ জানতে পারে, মেয়েটি সংঘবদ্ধ নারী পাচারকারী চক্রের ফাঁদে পড়েছে। এক পর্যায়ে তাকে কেরানীগঞ্জের জিনজিরা এলাকা থেকে উদ্ধার করে পুলিশ।
মেয়েটির বাবা বলেন, ‘মেয়েকে সব সময় শাসনের মধ্যেই রেখেছি। কিন্তু পরিবর্তনটা এসেছে মেয়েকে স্মার্টফোন দেওয়ার পর। অনলাইনে স্কুলের ক্লাস করার জন্য তাকে ফোন দিতে হয়েছে। এখন আরো সতর্ক হতে হবে।’
একইভাবে গত ২৬ আগস্ট মিরপুর মডেল থানায় তরুণী (১৯) নিখোঁজ হওয়ার তথ্য জানিয়ে জিডি করেন তাঁর বাবা। ৫ সেপ্টেম্বর পুরান ঢাকার একটি এলাকা থেকে তাঁকে উদ্ধার করে পুলিশ। ছেলে বন্ধুর সঙ্গে চলে গিয়েছিলেন তিনি। থানা পুলিশ হওয়ায় ছেলেটি সটকে পড়লেও ছেলের পরিবার মেয়েটির দায়িত্ব নিতে চায়। পরে দুই পরিবারের বোঝাপড়ার মাধ্যমে মেয়েটিকে বাবার কাছে দেওয়া হয়।
তবে পুলিশ জানায়, মেয়েটিকে ফেলে ছেলে পালিয়ে গেছে। ছেলেটিকে আটক করার চেষ্টা চলছে।
মিরপুর মডেল থানার ওসি মোস্তাজিরুর রহমান বলেন, তাঁর থানা এলাকা থেকে জুলাই মাসে ২০, আগস্টে ৪০ ও সেপ্টেম্বরে ৪৫ শিক্ষার্থী নিখোঁজ হওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এই ১০৫ জনের মধ্যে উদ্ধার হয়েছে এবং নিজ ইচ্ছায় পরিবারে ফিরেছে ৮০ শিক্ষার্থী। বাকিদের উদ্ধারের চেষ্টা চলছে।
জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার (ডিএমপি) মুহা. শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘গত কয়েক মাসে এটা বেড়েছে। নিখোঁজ কিশোরীদের উদ্ধার অভিযানে নেমে দেখা গেছে, মোবাইল বা ফেসবুকের একটা প্রভাব এখানে আছে। সন্তান, অভিভাবক কেউ কারো ঠিকমতো খোঁজ রাখছে না। অপ্রাপ্তবয়স্ক এই সন্তানদের সঠিক পথে পরিচালনা করতে অভিভাবকদেরই দায়িত্ব নিতে হবে। ’
মিরপুর এলাকায় সরেজমিনে গিয়ে অন্তত ২০ জন অভিভাবকের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তাঁরা জানান, করোনা পরিস্থিতির কারণে গত দেড় বছর স্কুল-কলেজে যাওয়া বন্ধ ছিল। পরীক্ষা, পড়া, কোচিংসহ সবই চলছে অনলাইনে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে নির্দেশনার কারণে স্বাভাবিকভাবে পড়ুয়াদের সবার হাতে মোবাইল ফোন দিতে হয়েছে। লেখাপড়ার ফাঁকে তারা বিভিন্ন গেমসের প্রতি যেমন ঝুঁকেছে, তেমনি অনেকে চেনা-অচেনা বন্ধুদের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছে।
সংশ্লিষ্ট থানার ওসিদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ভাসানটেক এলাকা থেকে গত তিন মাসে অন্তত ৩০ কিশোরী, শাহ আলী থানা এলাকা থেকে ৪০, কাফরুল থানা এলাকা থেকে ৪৫, দারুসসালাম থানা এলাকা থেকে ৩৭ এবং রূপনগর থানা এলাকা থেকে ৫৩ কিশোরী নিখোঁজের ঘটনায় জিডি করা হয়েছে।
জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের সদস্যসচিব নাসিমা আক্তার বলেন, ‘অনেক অভিভাবক সন্তানদের প্রযুক্তি ব্যবহারের বিষয়ে সচেতন নন। কারণ তাঁরাও অনেক কিছু বুঝতে পারেন না। এটা আমাদের এক ধরনের সংকট বলা যায়। এখন পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র নিজের জায়গা থেকে কাজ করলে উত্তরণ সম্ভব।
একটি বিশেষ এলাকার তরুণীদের ঘর ছাড়ার ঘটনায় উদ্বেগ বাড়ছে পুলিশের মধ্যেও। অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, না বুঝে ঘর ছাড়া এসব শিশু-কিশোরীর একটি অংশ মানসম্মান ও অভিভাবকদের ভয়ে একসময় পরিবারে ফেরার সাহস হারিয়ে ফেলবে। এই সুযোগে সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্র ফাঁদে ফেলে তাদের বিদেশে পাচার কিংবা বিক্রি করে দিতে পারে।
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ওমর ফারুক বলেন, ইন্টারনেটের নেতিবাচক দিকে সহজেই আকৃষ্ট হচ্ছে উঠতি বয়সী তরুণ-তরুণীরা, যার ভুক্তভোগী অভিভাবকরা। সবার অজান্তে অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছে অনেক মূল্যবান জীবন। আবার এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে দৃশ্যমান কোনো আইন নেই।
বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি সালমা আলী বলেন, পরিবারের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতা বোধ করা শিশু-কিশোরী বা তরুণ-তরুণীরা ঘরবিমুখ হচ্ছে। অভিভাবক ও শিক্ষকদের এ ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে।
ইউকে/এএস