মানুষের প্রথম ভাষা কান্না

বার্তাকক্ষ প্রতিবেদন: পৃথিবীর সব মানুষের প্রথম ভাষা কান্না। সেক্ষেত্রে কান্নাকে পৃথিবীর প্রথম ভাষা বলা যেতেই পারে। কান্নার ভাষা সর্বজনীন। সব ভাষার মানুষ কাঁদে। কান্নার ভাষা সব ভাষাভাষি বোঝে। একজন নবজাতকও নিজের অস্তিত্ব জানান দেয় কান্নার মাধ্যমে। এটা তার সুস্থতার প্রকাশও।

দুঃখ, কষ্ট বা আনন্দে মানুষ কাঁদে। এই কান্নায় কী কেবলই মনের খেদ বা আবেগের প্রকাশ ঘটে, না কিছু লাভও হয় সম্প্রতি হাফিংটন পোস্টের এক ব্লগে চোখের পানি ফেলার ওপর গুরুত্ব দিয়ে বলা হয়েছে- কান্নায় বেদনা প্রশমিত হয় এবং মানুষকে কোনো সমস্যা থেকে সেরে উঠতে সহায়তা করে।

দ্য ইন্ডিপেনডেন্টের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, ১৪০ বছরে কান্নার ওপর বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত নিবন্ধের বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে যে, ৯৪ শতাংশ ক্ষেত্রেই কান্নাকে গুণ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। তবে এটা বলে রাখি যে- এই গুণ না থাকলে বা অধিক কান্না না হওয়ার সঙ্গে কিন্তু ক্যানসার, অ্যাজমা, উচ্চ রক্তচাপের মতো সমস্যার যোগসূত্রও রয়েছে।

এখন আসুন, আমরা কেন এবং কীভাবে কান্না করি সেদিকে একটু নজর দেই। কান্না আসলে সিক্রেটোমোটর ফেনোমেননের, সোজা কথায় একটি জটিল প্রক্রিয়া, যা চোখের ল্যাক্রিমাল অংশ থেকে পানি আকারে বের হয়। মানবদেহের মস্তিষ্কের সঙ্গে ল্যাক্রিমাল গ্লান্ডের অন্তঃযোগাযোগ রয়েছে। ফলে যখনই আমাদের মস্তিষ্কে আবেগঘন মুহূর্ত তৈরি হয়, তখনই ল্যাক্রিমাল গ্লান্ডে আঘাত করে এবং এর ফলে আমরা কান্না করি।

গবেষকরা মনে করেন, মানুষ যখনই কষ্ট অনুভব করে, তখন কান্নার মাধ্যমে এক ধরনের হরমোন নিঃসৃত হয়। যার ফলে সে হালকা এবং প্রশান্তি অনুভব করে। এ কারণে দেখা যায় কান্না করলে মানসিক চাপ অনেক কমে আসে।

মানব শরীর সাধারণত তিন ধরনের কান্না উৎপাদন করে। একটা হলো মৌলিক, যা শুষ্কতা থেকে রক্ষার জন্য চোখের বলের ওপরে তৈলাক্ত স্তর তৈরি করে। আরেকটি হলো প্রতিবিম্ব, যা চোখে ধূলিকণা বা কিছু পড়লে সেটা থেকে চোখকে রক্ষার জন্য হাজির হয়। পেঁয়াজ কাটার সময় বা তীব্র আলোর মুখোমুখি হলেও এটা হয়ে থাকে। অর্থাৎ চোখ কোনোভাবে বিরক্ত হলে প্রতিবিম্বের মাধ্যমে চোখ দিয়ে পানি বের হয়। তৃতীয়টা হলো আবেগীয়, যা সংবেদনশীল কোনো কারণে ঘটে থাকে। আবেগীয় বা সংবেদনশীল অশ্রুতে মৌলিক ও প্রতিবিম্বের চেয়ে প্রোটিনের মাত্রা বেশি থাকে। প্রোটিনের কারণে অশ্রু অনেক ঘন হওয়ায় ধীরে ধীরে সেগুলো চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ে।

এই অশ্রুগুলো যত বেশি গড়িয়ে পড়বে, অন্যদের জন্য তার বার্তাগুলো তত বেশি উপলব্ধি করার সুযোগ তৈরি হবে। সংবেদনশীল অশ্রু একটি সামাজিক ও জৈবিক সংকেত। এটা যোগাযোগেরও একটা মাধ্যম। কিন্তু অনেক সময় মানুষ একা একাই কান্না করে থাকে, যেখানে কান্নার প্রেরক থাকলেও প্রাপক থাকে না!

আপনি হয়তো লক্ষ্য করে থাকবেন যে, একই সঙ্গে কান্না করা এবং গান গাওয়া প্রায় অসম্ভব! এর কারণ হলো- গলার পেশি একসঙ্গে কান্না ও গানের সংকোচন-প্রসারণ করতে পারে না। এজন্য কান্না বিষয়ক গবেষক হিদার ক্রিস্টলের মতে, কান্নার বিপরীত শব্দ হাসি নয়; বরং- গান। কেননা কান্না লুকিয়ে গান গাইতে না পারলেও হাসতে পারেন অনেকে!

দুঃখ, রাগ বা আনন্দ- যেকোনো আবেগ থেকে যে কান্না আসে, তা মানুষের মধ্যে মনুষ্যত্বের গুণ তুলে ধরে। তবে কান্নার বিষয়টি সংস্কৃতি ভেদে ভিন্নরূপে দেখা যায়। যেমন ইন্দোনেশিয়ার তোরাজায় শোকসন্তপ্ত ব্যক্তি বাদে আর কেউ কাঁদলে এটাকে অস্বাস্থ্যকর, মানসিক সমস্যা ও স্বল্প বয়সে মৃত্যুর পূর্বলক্ষণ হিসেবে ধরা হয়।

যা হোক, আপনি কি জানেন একজন ব্যক্তি কতবার কাঁদে নেদারল্যান্ডসের টিলবার্গের গবেষক অ্যাড ভিঙ্গারহোটস ৩৫টি দেশের পাঁচ হাজার ব্যক্তিকে নিয়ে একটি গবেষণা চালিয়েছেন। গবেষণায় দেখা গেছে, এক বছরে একজন নারী গড়ে ৩০ থেকে ৬৪ বার পর্যন্ত কাঁদতে পারে। আর একজন পুরুষ কাঁদতে পারে ছয় থেকে ১৭ বার পর্যন্ত। অর্থাৎ নারীদের কান্নার হার পুরুষের প্রায় চার থেকে পাঁচ গুন। পুরুষের টেস্টোস্টেরন হরমোন কান্না থামিয়ে রাখে। আর নারীর শরীরে উচ্চমাত্রায় প্রোল্যাকটিন হরমোনের কারণে বেশি কান্নাকাটি করে। গর্ভধারণের সময় এই হরমোন বেশি থাকে বলে এ সময় নারীকে বেশি কান্নাকাটি করতে দেখা যায়।

অপরদিকে প্রাপ্তবয়স্কদের কান্নার ক্ষেত্রে ধারাবাহিক গবেষণা নেই আর প্রাপ্তবয়স্কের কান্নাকাটির সুফল কী- এ বিষয়টিও নির্দিষ্ট করতে পারেননি গবেষকেরা। তবে গবেষণায় দেখা গেছে, ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ মানুষ মনে করে- কান্নার ফলে তাঁদের বিচলিত অবস্থা কিছুটা কমে যায়।

গবেষকেরা বলেন, মানুষ যখন অসহায় বোধ করে, তখন বেশি কাঁদে। কেঁদে যদি অবস্থার উন্নতি ঘটে, তখন সে স্বস্তিবোধ করে। এছাড়া কান্না পালস রেট কমিয়ে শরীর সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। কিছুটা কান্না আপনার রক্তচাপকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করবে। তাইতো আনন্দ, নিপীড়ন, শোক, সৌন্দর্য ও হিংস্রতা বোঝার জন্য কান্না একটা অনেক বড় অবলম্বন এবং গুণ। তাই প্রয়োজনে কাঁদুন, সুস্থ থাকুন।

ইউকে/এসএই