নিজস্ব প্রতিবেদক: উপমহাদেশের প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক আর নেই (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।
সোমবার (১৫ নভেম্বর) রাত সোয়া ৯টার দিকে নিজ বাসভবন উজানে তার মৃত্যু হয়।
তিনি দীর্ঘ দিন থেকে বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছিলেন। দীর্ঘ ১৯ দিন পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল থেকে গত ৯ সেপ্টেম্বর ছাড়া পান প্রখ্যাত সাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক। শঙ্কামুক্ত হয়ে ৯ সেপ্টেম্বর হাসপাতাল থেকে তাকে রাজশাহীর বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। এরপর থেকে বাড়িতেই চিকিৎসা চলছিল বলে জানিয়েছেন- তার ছেলে ড. ইমতিয়াজ হাসান। রাতে তার মৃত্যুর খবরে ছড়িয়ে পড়লে শোকের ছায়া নেমে আসে।
এর আগে, গত ২১ আগস্ট হাসান আজিজুল হকের শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে রাজশাহীর হযরত শাহ মখদুম বিমানবন্দর থেকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকার জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে আনা হয়। সেখানে কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে হৃদযন্ত্রের সমস্যার বাইরেও ফুসফুসে সংক্রমণ, ইলেকট্রোলাইটের ভারসাম্যহীনতাসহ নানা সমস্যা ধরা পড়ে। পরবর্তীতে তাকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থানান্তর করা হয়। সেখানে হাসান আজিজুল হককে হাই-ফ্লো অক্সিজেন সাপোর্টও দেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও ইন্টারনাল মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ড. আরাফাতের নেতৃত্বে গঠিত মেডিক্যাল টিম তার চিকিৎসা করেন।
হাসান আজিজুল হক ১৯৩৯ সালের ২ ফেব্রুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার যব গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮২ বছর। তিনি তিন মেয়ে ও এক ছেলেসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। হাসান আজিজুল হকের স্ত্রী বেগম শামসুন্নাহার ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি মারা গেছেন। তার ছেলে ইমতিয়াজ হাসান মৌলি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগের শিক্ষক। তার বড় মেয়ে সুমন ঢাকায় থাকেন। মেঝ মেয়ে শুচিস্মিতা সুচি রাজশাহী বঙ্গবন্ধু কলেজের প্রভাষক। ছোট মেয়ের নাম তোতন।
১৯৫৮ সালে রাজশাহী কলেজ থেকে দর্শন শাস্ত্রে সম্মানসহ স্নাতক ডিগ্রি লাভ করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৯৬০ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৭৩ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন বিভাগে অধ্যাপনা করেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩১ বছর শিক্ষকতার পর ২০০৪ সালে তিনি অবসর নেন।
হাসান আজিজুল হক উপন্যাস, ছোটগল্প, নাটক ছাড়াও বিভিন্ন বিষয়ে বিশ্লেষণধর্মী রচনা লিখে দেশের সাহিত্যাঙ্গনে নিজের অবস্থান মজবুত করেন।
গল্পগ্রন্থ সমুদ্রের স্বপ্ন, শীতের অরণ্য কিংবা উপন্যাস আগুনপাখি তাকে নিয়ে গেছে অনন্য এক উচ্চতায়। হাসান আজিজুল হকের উল্লেখযোগ্য রচনাগুলোর মধ্যে রয়েছে আত্মজা ও একটি করবী গাছ, জীবন ঘষে আগুন, পাতালে হাসপাতালে, নামহীন গোত্রহীন, চলচিত্রের খুটিনাটি, মা মেয়ের সংসার, বিধবাদের কথা ও অন্যান্য গল্প, সক্রেটিস, বৃত্তায়ন, শিউলি, আগুনপাখি, ফিরে যাই ফিরে আসি, উঁকি দিয়ে দিগন্ত প্রভৃতি।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বইয়ের মধ্যে রয়েছে একাত্তর: করতলে ছিন্নমাথা, লাল ঘোড়া আমি, ফুটবল থেকে সাবধান ইত্যাদি। সম্পাদিত বইয়ের মধ্যে রয়েছে গোবিন্দচন্দ্র দেব রচনাবলী, একুশে ফেব্রুয়ারি গল্প সংকলন, জন্ম যদি তব বঙ্গে ইত্যাদি।
কথাসাহিত্যে অনবদ্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার, পদক ও সম্মাননা। এর মধ্যে রয়েছে আদমজী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৬৭), বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৭০), অলক্ত সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮১), আলাওল সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৩), অগ্রণী ব্যাংক সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৪), ফিলিপস সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৮), কাজী মাহবুব উল্লাহ ও বেগম জেবুন্নিসা পুরস্কার।
এছাড়া ১৯৯৯ সালে ‘একুশে পদকে’ ভূষিত হন হাসান আজিজুল হক। ‘আগুনপাখি’ উপন্যাসের জন্য পেয়েছেন আনন্দ পুরস্কার। ২০১২ সালে তিনি ভারতের আসাম বিশ্ববিদ্যালয় ও ২০১৮ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডিলিট ডিগ্রি পান।
দীর্ঘ ৩১ বছর অধ্যাপনার পর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অদূরে বিশ্ববিদ্যালয় হাউজিং সোসাইটিতে (বিহাস) নিজ বাড়ি উজানে লেখালেখি নিয়ে মগ্ন ছিলেন হাসান আজিজুল হক।
ইউকে/এসএম