বার্তাকক্ষ প্রতিবেদন: রমজান আলী। বয়স এখন ৭৩। কৃষি কর্মকর্তা হিসেবে চাকরি পান ১৯৭০ সালে। ২৩ জুন ১৯৭১ সালে চাকরিতে যোগ দেন ঠাকুরগাঁওয়ে মহকুমা কৃষি কর্মকর্তা হিসেবে। এরপর পদোন্নতি পেয়ে হন জোনাল কর্মকর্তা।
হঠাৎ একদিন শুনলেন ভ্রমণ ভাতা হিসেবে দুটো কাগজে ৯৯০.৫০ টাকা চেয়ে তিনি ট্রেজারি অফিসে বিল জমা দিয়েছেন। এর মধ্যে ৫১৬.৬৮ টাকার বিল ১৯৭৬ সালের ৪ সেপ্টেম্বর ও ৪৭৩.৮২ টাকার বিল একই বছরের ৭ সেপ্টেম্বর জমা দেওয়ার অভিযোগ উঠে। তাতে ঊর্ধ্বতনের স্বাক্ষর জাল।
স্বাক্ষর জাল করে বিল জমা দেওয়ার অভিযোগে কোনো কারণ দর্শানোর নোটিশ না দিয়েই তৎকালীন দুর্নীতি দমন ব্যুরোর পক্ষে ডিবির ইন্সপেক্টর একে ঘোষ রমজান আলীর বিরুদ্ধে ১৯৭৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর মামলা করেন। তদন্ত কর্মকর্তা রমজান আলী তদন্ত শেষে ৭৮ সালের ৩০ মে চার্জশিট দেন। চার্জশিটের পর তাঁকে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। বিচার প্রক্রিয়া শেষে ১৯৮৮ সালের ১৬ আগস্ট রায় দেন রাজশাহী বিভাগের তৎকালীন স্পেশাল জজ মো. আব্দুল কাদের খান। রায়ে রমজান আলীর ৫ বছরের সাজা ও ৩০০ টাকা জরিমানা দেওয়া হয়। আর রায়ের পরই তাঁকে কারাগারে পাঠান আদালত।
রমজান আলীর পক্ষে সম্প্রতি হাইকোর্টে মামলা পরিচালনাকারী আইনজীবী মো. আব্দুল হাই সরকার বলেন, রায়ে নিম্ন আদালতের বিচারক তাঁর বিচারিক মন প্রয়োগ করেননি। কেননা, যে স্বাক্ষর জাল বলে মামলা করা হয়, তা পরীক্ষা করা হয়নি। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বা অভিযোগকারী আদালতে সাক্ষ্য দেননি। পরীক্ষা করা হয়নি বিল দুটোও। শুধুমাত্র অভিযোগের ভিত্তিতে আসামিকে সাজা দেওয়া হয়েছে। রায়ে বিচারক বলেছেন, সিজার লিস্টসহ (জব্দ তালিকা) অন্যান্য নথি ট্রেন ডাকাতির সময় হারিয়ে যায়। অথচ ডাকাতির ঘটনায় নথিপত্র হারিয়ে যাওয়ার কথা কোনো সাক্ষী আদালতে বলেননি। এমনকি ডাকাতির কথা উল্লেখ ছিল না মামলার এজাহার বা চার্জশিটেও।
আব্দুল হাই বলেন, ১৯৮৫ সালের গণ–কর্মচারী সাজা প্রাপ্তিতে বরখাস্ত সংক্রান্ত অধ্যাদেশ অনুযায়ী–আপিলে খালাস পাওয়ার পর অবসরের বয়সসীমা পার না হলে আপিলকারী চাকরিতে পুনর্বহাল হন। কিন্তু রমজান আলীর বয়সসীমা পার হয়ে গেছে। এখন তাঁকে ক্ষতিপূরণের জন্য পৃথক রিট করতে হবে। তবে পূর্ণাঙ্গ রায়ে এ বিষয়ে পর্যবেক্ষণ থাকতে পারে বলে জানান তিনি।
কারাগারে থাকা অবস্থায় রমজান আলীর ভাইয়ের ছেলে ওই রায়ের বিরুদ্ধে একই বছর হাইকোর্টে আপিল করেন। সেই সঙ্গে তাঁর জামিন চান। তিন মাস পর হাইকোর্ট তাঁকে জামিন দেন। জামিনে মুক্ত হলেও সাজা হওয়ায় চাকরি আর ফিরে পাননি রমজান। মুক্ত হওয়ার পর অভাবের কারণে স্ত্রী তাঁকে তালাক দিয়ে চলে যান।
যদিও পরবর্তীতে পরিবারের লোকজন তাকে দ্বিতীয়বার বিয়ে করান। চাকরি ফিরে না পেলেও কৃষিবিদ ইনস্টিটিউট থেকে তাঁকে বিভিন্ন সময় নানাভাবে সাহায্য করা হতো। সামান্য জমিতে কৃষি কাজ করতেন। তা দিয়েই চলতেন তিনি। একটি এনজিওতে চাকরি করেন কিছুদিন। তবে অভাবের কারণে ধীরে ধীরে সব জমিই বিক্রি করে দিতে হয়েছে। বর্তমানে তাঁর সামান্য বসতভিটা ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই বলে জানিয়েছেন রমজান আলী।
রমজান আলী বলেন, যে বিলে স্বাক্ষর জালিয়াতির অভিযোগে মামলা হয়েছিল আমি তা জমাই দিইনি। তৃতীয় কেউ আমাকে ফাঁসানোর জন্য বিল জমা দিয়েছিল। আমার সঙ্গে থাকা দুজন সচিব পর্যন্ত হয়েছেন। অথচ আমাকে কত কষ্ট করতে হয়েছে। ঠিকমতো খাবারও জোটে না। আমি চাই চাকরির সুবিধা। যাতে শেষ বয়সে কিছুদিন ভালো করে চলতে পারি। সন্তানদেরও জন্যও কিছু করে যেতে পারি।
সম্প্রতি পুরোনো মামলা শুনানিতে উঠলে উচ্চ আদালত থেকে খবর দেওয়া হয় রমজান আলীর বাড়ির ঠিকানা চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জের বিরাহীমপুর গ্রামে। পরে তিনি এলাকার একজনের সহযোগিতায় মামলা পরিচালনার জন্য আইনজীবী নিয়োগ দেন। শুনানি শেষে গত ২৪ নভেম্বর বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকি ও বিচারপতি মো. সোহরাওয়ার্দীর বেঞ্চ রায় দেন। রায়ে রমজান আলীকে খালাস দেন হাইকোর্ট। হাইকোর্ট সবকিছু দেখে বিস্ময় প্রকাশ করেন।
উচ্চ আদালতে শুনানিতে দুর্নীতি দমন কমিশনকে পক্ষভুক্ত করা হয়। জানতে চাইলে দুদকের আইনজীবী আসিফ হাসান বলেন, আসামিরা অনেক সময় জামিন পাওয়ার পর আর মামলার খোঁজ রাখেননা, খেয়াল রাখেননা আইনজীবীও। যার কারণেই মামলা এত সময় নিষ্পত্তি হয়নি।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, অপরাধ প্রমাণ না হলে চাকরিকালীন সুবিধা সরকারের কাছে চাওয়ার সুযোগ রয়েছে ভুক্তভোগীর। দীর্ঘ দিনেও আবেদন নিষ্পত্তি না হওয়া বিচার বিভাগের দুর্বলতা। বিচার বিভাগে এখন ট্রাফিক জ্যামের মতো অবস্থা। দ্রুত বিচার পাওয়া বিচারপ্রার্থীর অধিকার। এ জন্য বিচারের সিস্টেম স্টাবলিশ করতে হবে, যাতে সবকিছু সঠিক সময়ে হয়। মহাপরিকল্পনার মাধ্যমে বিচার বিভাগের সমস্যা চিহ্নিত করে এর সমাধান করতে হবে বলে জানান তিনি।
ইউকে/এসই