কোলাহলের শহরে সুনশান নিরাবতা

নিজস্ব প্রতিবেদক: সর্বাত্মক লকডাউন শুরুর দ্বিতীয় দিনেও রাজশাহীতে কঠোর অবস্থানে রয়েছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। ফলে কোলাহলের শহরে নেমে এসেছে সুনশান নিরাবতা। মহানগর পুলিশের পাশাপাশি জেলা পুলিশের রিজার্ভ ফোর্স সদস্যদেরও লকডাউন কার্যকরে মাঠে নামানো হয়েছে। শনিবার (১২ জুন) সকাল থেকে তারা মহানগর পুলিশের সাথেই দায়িত্ব পালন করছে।

পুলিশের পাশাপাশি র‌্যাব সদস্যরাও বিভিন্ন সড়কে টহল দিচ্ছে। ফলে সেভাবে কেউই বাড়ির বাইরে বের হতে পারছেন না। কাঁচা বাজার, খাদ্য পণ্য ও ওষুধ কেনার মত নিতান্ত জরুরি প্রয়োজন যারা রাস্তায় বের হচ্ছেন- তাদেরকে পুলিশের জেরার মুখে পড়তে হচ্ছে। যথাযথ কারণ দেখাতে ব্যর্থ হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে আবারও বাড়ি ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

তাই বিভাগীয় শহর রাজশাহীর পথ-ঘাট এখন প্রায় জনশূন্য। ফাঁকা সড়কে রয়েছে কেবল পুলিশ।শহরের তিনটি প্রবেশমুখসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে বসানো হয়েছে চেকপোস্ট। রাস্তায় দু’একটি রিকশা, মোটরসাইকেল এবং জরুরি সেবার গাড়ি চলাচল করতে দেখা যাচ্ছে।

বন্ধ রয়েছে শহরের সব মার্কেট, বিপণী বিতান এবং সব ধরনের দোকানপাট। লকডাউনের কঠোরতায় স্বাভাবিক জীবনযাত্রা একেবারেই মন্থর হয়ে পড়েছে। অতিমারির মধ্যে শহরের জনবহুল পথ-ঘাট যে খাঁ খাঁ করছে।

শনিবার (১২ জুন) সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত রাজশাহী মহানগরীর শহীদ এএইচএম কামারুজ্জামান চত্বর, শিরোইল বাস টার্মিনাল, রেলওয়ে স্টেশন, নিউমার্কেট, সাহেববাজার জিরোপয়েন্ট, সোনাদীঘির মোড়, লক্ষ্মীপুরসহ কয়েকটি জনবহুল এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, রাস্তাঘাট একেবারেই মানুষ নেই। মূল সড়কে পিকআপ ভ্যান নিয়ে এবং পাড়া-মহল্লায় মোটরসাইকেল নিয়ে টহল দিচ্ছে পুলিশ।

তবে নিত্যপণ্যের দোকান, ওষুধের ফার্মেসী ও পেট্রোল পাম্প, ব্যাংক ও বীমা প্রতিষ্ঠান আগের মতই খোলা রয়েছে। এছাড়া সব ধরনের ব্যবসায়ী দোকানপাট সকাল থেকে বন্ধ দেখা গেছে।

রাজশাহী মহানগরীর প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে পুলিশ সদস্যরা অবস্থান নেওয়ায় কেউ রাস্তায় বের হলে পড়তে হচ্ছে জেরার মুখে। জরুরি কাজ থাকলে পুলিশ সদস্যরা তাকে দ্রুত কাজ শেষ করে ঘরে ফেরার নির্দেশনা দিচ্ছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা কঠোর অবস্থানে রয়েছেন।শহরের তিন দিকের প্রবেশমুখ আমচত্বর, কাশিয়াডাঙ্গা ও কাটাখালী এলাকায় পুলিশ সদস্যরা ব্যারিকেড দিয়ে দায়িত্ব পালন করছেন। এসব পয়েন্ট মানুষ ও যানবাহনের অবাধ প্রবেশ ঠেকাতে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা বলয় গড়ে তুলেছে মহানগর পুলিশ। পণ্যবাহী পরিবহন, পিকআপ ভ্যান ও মালবাহী ট্রাক ছাড়া কিছুই রাজশাহী শহরে ঢুকতে বা বাহির হতে দেওয়া হচ্ছে না।

রাজশাহীর অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আবু আসলাম বলেন, নির্দেশনা অনুযায়ী সর্বাত্মক লকডাউন বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এ অবস্থায় কেউ অহেতুক বাইরে ঘোরাঘুরি করলে তাকে ভ্রাম্যমাণ আদালতের শাস্তির মুখেও পড়তে হবে। তাই কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যে জরুরি প্রয়োজন ছাড়া তিনি সবাইকে ঘরে থাকার আহ্বান জানান।

এদিকে, করোনাভাইরাসের ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণ ঠেকাতে এবার উত্তরের সীমান্তবর্তী জেলা রাজশাহীতে সাত দিনের সর্বোচ্চ ‘লকডাউন’ চলছে। পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী গতকাল শুক্রবার (১১ জুন) বিকেল ৫টা থেকে এই বিশেষ লকডাউন কার্যকর করা হয়েছে। ১৭ জুন মধ্যরাত পর্যন্ত এই সর্বাত্মক লকডাউন বলবৎ থাকবে। রাজশাহী সিটি করপোরেশনের পাশাপাশি জেলার নয় উপজেলায়ও এই বিশেষ লকডাউন চলছে। স্ব-স্ব উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা লকডাউন পরিস্থিতি মনিটরিং করছেন। এছাড়া সার্বিক পরিস্থিতি দেখভাল করছেন- খোদ রাজশাহী জেলা প্রশাসক মো. আব্দুল জলিল।

এছাড়া লকডাউন কার্যকরের পর থেকে রাজশাহী মহানগর পুলিশ কমিশনার মো. আবু কালাম সিদ্দিকও পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন।

এর আগে গত বৃহস্পতিবার (১০ জুন) রাতে রাজশাহী সার্কিট হাউজে এক বিশেষ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় জেলায় করোনা পরীক্ষার তুলনায় শনাক্তের হার ও মৃত্যু হার বিশ্লেষণ করা হয়। পরে সভা শেষে বিভাগীয় কমিশনার ড. মো. হুমায়ুন কবীর সাংবাদিকদের সর্বাত্মক লকডাউন কার্যকরের এই সিদ্ধান্তের কথা জানান।

রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার ড. হুমায়ুন কবীর বলেন- রাজশাহীতে ফের সংক্রমণের হার বেড়েছে। তাই পাশের ভারত সীমান্ত জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জের পর এবার রাজশাহী জেলায়ও বিশেষ লকডাউন জারি করা হলো। করোনায় মৃত্যু ও সংক্রমণ বিবেচনায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

পরে জেলা প্রশাসক মো. আব্দুল জলিল এ বিশেষ লকডাউনের ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, রাজশাহীতে প্রথমে সন্ধ্যা ৭টা থেকে পরদিন সকাল পর্যন্ত বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। তারপর গত ২ জুন আরও দুই ঘণ্টা এগিয়ে বিকেল ৫টা থেকেই বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। এই ক’দিন আমরা পর্যবেক্ষণ করছিলাম। কোথাও করোনার নিম্নমুখী সংক্রমণ, কোথাও ঊর্দ্ধমুখী। কিন্তু ঊর্দ্ধমুখী সংক্রমণই বেশি। তাই শুক্রবার বিকেল ৫টা থেকে ১৭ জুন মধ্যরাত পর্যন্ত রাজশাহীতে বিশেষ লকডাউন থাকবে।

রাজশাহী জেলা প্রশাসক মো আব্দুল জলিল জানান, লকডাউনের সময় সব ধরনের ব্যবসায়ীক দোকানপাট ও যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকবে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নাটোর ও নওগাঁসহ আশপাশের অন্য কোনো আন্তঃজেলা থেকে যানবাহন প্রবেশ করতে পারবে না। রাজশাহী থেকেও কোনো যানবাহন বাইরের জেলায়ও যেতে পারবে না। এছাড়া রাজশাহী থেকে ঢাকাসহ সব দূর পাল্লার রুটের বাস ও অন্যান্য যানবাহন এবং যাত্রীবাহী সকল আন্তঃনগর ও মেইল ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকবে। তবে রাজশাহীর আম পরিবহনকারী ‘ম্যাংগো স্পেশাল’ এবং পণ্যবাহী ট্রেন আগের মতই চলবে। এছাড়া রোগী, খাদ্য, জরুরি ওষুধ ও পণ্যবাহী পরিবহনসহ অন্য জরুরি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান এবং ওষুধ সরবরাহকারী পরিবহন ইত্যাদির ক্ষেত্রে এ নিষেধাজ্ঞা প্রযোজ্য হবে না।

রাজশাহীতে আমের মৌসুম চলছে। তাই আমের বাজারগুলো এখন বড় পরিসরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসবে। তবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে বাজার পরিচালনা করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

ইউকে/এসই/এসএম