মাহে রমজান কেন এত গুরুত্বপূর্ণ

আবু সালেহ মুহাম্মদ তোহা ১ এপ্রিল, ২০২২ ০০:০০ | পড়া যাবে ৬ মিনিটে

রমজান মহান আল্লাহর অপূর্ব রহমতের বারিধারায় সমৃদ্ধ এবং তাঁর সান্নিধ্য লাভের সুবর্ণ সুযোগসংবলিত একটি মাস। এ মাস মুমিনের প্রার্থিত এবং ইবাদতের বসন্ত হিসেবে পরিচিত। মাহে রমজানের প্রতি ঈমানদারদের অনুরাগ ও আগ্রহ সীমাহীন। মহিমান্বিত এ মাসের মর্যাদা অপরিসীম।

রোজার মাস: রোজার মতো গুরুত্বপূর্ণ আমলের জন্য মহান আল্লাহ রমজান মাসকে নির্ধারিত করেছেন। রমজান মাস মর্যাদাপূর্ণ হওয়ার জন্য এটিই যথেষ্ট। আল্লাহ বলেন, ‘সুতরাং তোমাদের মধ্যে যারা এই মাস পাবে তারা যেন এই মাসে রোজা পালন করে। ’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ১৮৫)

কোরআনের মাস: মহান আল্লাহ মানবজাতির হিদায়াতের জন্য সর্বশেষ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ কোরআন রমজান মাসে অবতীর্ণ করেছেন। কোরআনের সূত্র ধরেই রমজান শ্রেষ্ঠ মাস হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। আল্লাহ বলেন, ‘রমজান মাস, এতে মানুষের দিশারি এবং সৎপথের স্পষ্ট নিদর্শন ও সত্যাসত্যের পার্থক্যকারীরূপে কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে। ’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ১৮৫)

লাইলাতুল কদরের মাস: লাইলাতুল কদর বা কদরের রাত হাজার মাস হতে উত্তম। হাজার মাসে ৮৩ বছর চার মাস হয়। মহিমান্বিত এই রাত রমজান মাসেই। আল্লাহ বলেন, ‘আর আপনি কি জানেন কদরের রাত কী? কদরের রাত হলো হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। এ রাতে ফেরেশতা ও রুহুল কুদুস [জিবরাইল (আ.)] তাদের পালনকর্তার আদেশক্রমে প্রত্যেক মঙ্গলময় বস্তু নিয়ে (পৃথিবীতে) অবতরণ করে। (এ রাতের) আগাগোড়া শান্তি, যা ফজর হওয়া পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। ’ (সুরা কদর, আয়াত : ২-৫)

রহমতের দুয়ার উন্মুক্ত হওয়ার মাস: রমজান মাসে আল্লাহর রহমত ও জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয়। জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেওয়া হয়। আর অভিশপ্ত ও অবাধ্য শয়তানকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয়। এসবই রমজান মাসের বরকত। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যখন রমজান মাস আসে তখন জান্নাতের দরজাসমূহ উন্মুক্ত করে দেওয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেওয়া হয়। আর শয়তানকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয়। ’ (বুখারি, হাদিস : ৩১০৩; মুসলিম, হাদিস : ২৫৪৭)

ক্ষমা লাভের মাস: মহান আল্লাহ তাঁর বান্দাকে ক্ষমা করার জন্য এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য রমজান মাস দান করেন। এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে আল্লাহর ক্ষমা অর্জন করতে না পারাটা খুবই দুঃখজনক। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘ওই ব্যক্তির নাক ধুলায় ধূসরিত হোক, যার কাছে আমার নাম উচ্চারিত হওয়ার পরও আমার প্রতি দরুদ পড়ে না। ওই ব্যক্তির নাক ধুলায় ধূসরিত হোক, যার কাছে রমজান মাস এসে চলে যায়, অথচ তার পাপগুলো মাফ করিয়ে নিতে পারে না। ওই ব্যক্তির নাক ধুলায় ধূসরিত হোক, যে তার মাতা-পিতা বা তাদের একজনকে বার্ধক্য অবস্থায় পেয়েছে কিন্তু তারা তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাতে পারেনি। ’ (তিরমিজি, হাদিস : ৩৫৪৫)

দোয়া কবুলের মাস: রমজান মাসজুড়ে দোয়া কবুল হয়। রোজাদারের দোয়া ফিরিয়ে দেওয়া হয় না। রোজাদারের দোয়া কবুল হওয়ার বিষয়ে অনেক হাদিস বর্ণিত হয়েছে। জাবির (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘মহান আল্লাহ রমজান মাসের প্রত্যেক রাতে ও দিনে অসংখ্য লোককে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিয়ে থাকেন। আর প্রত্যেক মুসলমানের দোয়া কবুল করা হয়। ’ (শুয়াবুল ঈমান, হাদিস : ৩৬০৫)

ওমরাহর মর্যাদা হজের মতো হওয়ার মাস: রমজান মাসে ওমরাহ পালন রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে হজ পালনের মতো। ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘যখন রাসুলুল্লাহ (সা.) হজ থেকে ফিরে এলেন, তখন উম্মে সিনান নামক এক আনসারি নারীকে জিজ্ঞেস করলেন, কে তোমাকে হজ করা থেকে নিষেধ করল? জবাবে ওই নারী বলল, ওমুকের পিতা (তথা তার স্বামী)। তার পানি সেচের দুটি উট আছে। একটির ওপর সওয়ার হয়ে তিনি হজ করেছেন, আরেকটি দিয়ে জমিতে পানি সেচা হয়েছে। এরপর রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘রমজান মাসে ওমরাহ করা আমার সঙ্গে হজ আদায় করার সমতুল্য। ’ (বুখারি, হাদিস : ১৭৬৪)

জান্নাতকে সজ্জিত করার মাস: রমজান মাসকে কেন্দ্র করে বছরজুড়ে জান্নাতকে সাজানো হয়। এ সাজ রোজাদারদের জন্য এবং রমজানকে যথার্থভাবে পালনকারীদের জন্য। ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘জান্নাতকে বছরের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত রমজানের জন্যই সজ্জিত করা হয় এবং উন্নতমানের সুগন্ধি দ্বারা ধোঁয়া দেওয়া হয়। রমজান মাসের প্রথম তারিখ থেকে আরশে আজিমের নিচ থেকে বিশেষ ধরনের এক বাতাস বয়ে আসে, যার নাম ‘মশিরা’। যার দোলনায় জান্নাতের গাছের পাতা এবং দরজার কড়া এমনভাবে দোলে, যা থেকে মন মাতানো এক প্রকারের সুর-লহরি সৃষ্টি হয়। যে রকম আওয়াজ শ্রবণকারীরা এর আগে আর কখনো শোনেনি। ’ (শুআবুল ঈমান, হাদিস : ৩৬৯৫)

জাহান্নাম থেকে মুক্তির মাস: রমজান মাসে মহান আল্লাহ তাঁর ক্ষমা ও দয়াকে সুপ্রসারিত করেন। অসংখ্য লোককে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দান করেন। জাবির (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ রমজান মাসের প্রত্যেক রাতে ও দিনে অসংখ্য লোককে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিয়ে থাকেন। ’ (শুআবুল ঈমান, হাদিস : ৩৬০৫)

মধ্যবর্তী সময়ের কাফ্ফারার মাস: ভালো কাজের দ্বারা মন্দ কাজগুলো দূর হয়ে যায়। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, এক জুমা থেকে অন্য জুমা এবং এক রমজান থেকে অন্য রমজান মধ্যবর্তী সময়ের পাপসমূহের কাফ্ফারা হয়, যদি সে কবিরা গুনাহ থেকে বেঁচে থাকে। ’ (মুসলিম, হাদিস : ৫৭৪)

আসলে মাহে রমজানকে যথার্থভাবে উদ্যাপনের জন্য একটু আগে থেকেই প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) এর সময়ে রমজান যতই ঘনিয়ে আসত, রমজান নিয়ে তাঁর আগ্রহ, আলোচনা ও আমলের মাত্রা ততই বেড়ে যেত এবং তিনি সাহাবিদের রমজানের প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশ দিতেন। রমজানের পূর্ণ প্রস্তুতি গ্রহণ করে রমজানকে স্বাগত জানাতে মুমিনদের অপেক্ষার পালা শেষ হতে চলেছে। স্বাগতম মাহে রমজান।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, আরবি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

ইউকে/এসই