বার্তাকক্ষ প্রতিবেদক: নিত্যপণ্যের বাজারের ঊর্ধ্বগতিতে খাবারের খরচ জোগাতেই হিমশিম খাচ্ছে নিম্ন আয়ের মানুষ। রাজধানীর একজন রিকশা শ্রমিক ছয় মাস আগে যে খাবার ৩৫ টাকায় পেতেন, তাঁকে এখন এর চেয়ে একটু কম খাবার পেতেও দিতে হচ্ছে ৫০ টাকা। খরচ মেটানোর উপায় না পেয়ে কোনো কোনো শ্রমজীবী আবার খাবারে আমিষ রাখাই কমিয়ে দিয়েছেন। কেউ কেউ খাওয়া কমিয়ে দিয়েছেন।
তবু যেন খরচের হিসাব মিলছে না!
মঙ্গলবার (২৪ মে) বিকেল ৩টার দিকে কথাগুলো বলছিলেন নতুনবাজার এলাকার রিকশাচালক ইসমাইল মিয়া বললেন, ‘সকালবেলা বাইর হই, রাইতে গাড়ি (রিকশা) জমা দেওনের আগে দুই শ-আড়াই শ টাকার ভাড়া মারি। গ্যারেজে তিন বেলা খাইতে যায়গা ১৫০ টাকা। মেসে থাকার খরচ তো আছেই। আর অন্য খরচ তো বাদই দিলাম। আগে টুকটাক চা-রুটি খাইলেও এহন খাইতে পারি না। পাঁচ টাকার রুটি এহন ১০ টাকা চায়। কলার দামও বেশি, তয় কেমনে খামু?’
ছোলমাইদে রহমত মিয়ার গ্যারেজে গিয়ে দেখা যায়, আ. রহমান, মো. তোফাজ্জল, আবু বক্করসহ বেশ কয়েকজন রিকশাচালক দুপুরের খাবার খেয়ে বের হচ্ছেন।
কত টাকায় খেলেন জানতে চাইলে রহমত বলেন, ‘ভাই, আগে যে দামে খাইতাম এহন তো আর হেই দামে খাওন যায় না। হের পরও হোটেল-টোটেলের চাইতে আমাগো মেসের খরচ কম। এই জন্যে ভাড়া নিয়া যতদূরই যাই, খাই না। গ্যারেজে আইসা খাই। ’
গ্যারেজের মেস পদ্ধতিতে আগে কত খরচ হতো আর এখন কত হয় জানতে চাইলে পাশে থাকা তোফাজ্জল বলেন, ‘ভাই, এইখানেই আগে এক বেলা খাইলে ৩৫ টাকা দিতাম। কোনো দিন ডিম, কোনো দিন মুরগি, আবার কোনো দিন মাছ। এহন আগের চাইতে ভাত-তরকারি কম দিলেও দিতে হয় ৫০ টাকা। ’
তবে গ্যারেজের মেস মালিক সাহাবুদ্দিন সরদার বলেন, ‘আমরা হিসাবে কমই নিতাছি। তেলের দাম দুই গুণ, চালের দাম বাড়ছে। পেঁয়াজ থেকে শুরু কইরা কোন জিনিসের দাম বাড়ে নাই বলেন? তাইলে আমরা আর কয় টাকা বাড়াইছি। এই মেস চালিয়ে আমরাও তো চলতে হয়। ’
১০ দিনে ঘরে মাছ রান্না হয় নাই
রাজধানীর একটি পরিবহনের বাসের চালক জালাল উদ্দিন। নিত্যপণ্যের বাড়তি দাম নিয়ে গতকাল কথা হচ্ছিল তাঁর সঙ্গে।
জালাল বললেন, ‘জিনিসপত্রের দাম এত বাড়ছে, ঘর চালাইতে খবর হয়ে যাচ্ছে। প্রতিদিন নতুন করে চিন্তা করতে হয়। ১০ দিনে ঘরে মাছ রান্না হয় নাই। কোনো রকমে দিন পার করে দিচ্ছি। বাজারের খরচ তো প্রতিদিন লাগে। তাই অন্য সব জায়গায় খরচ ঠিক রাখতে হলে বাজারের খরচ কমাতে হয়। ’
সদরঘাট-টঙ্গী রুটে চলাচলকারী ভিক্টর ক্লাসিক বাসচালকের সহকারী দুলাল মিয়া বলেন, ‘সব কিছুর দাম বাইড়া গেছে। আমাগো ইনকাম বাড়ে নাই। আগে যেই টাকা পাইতাম এখনো ওই টাকাই পাই। …আমাদের দিন-রাতের বেশির ভাগ সময়ই রাস্তায় চলন্ত গাড়িতে কেটে যায়। খিদা লাগলে পথেই কিছু একটা খেয়ে লই। এখন সেই খাওয়াতেও টান পড়ছে। সংসারের খরচ বাড়ছে, ওই খরচ তো সহজে কমানো যাচ্ছে না। তাই পকেট খরচই কমাতে হচ্ছে। ’
প্রায় একই ধরনের অভিজ্ঞতার কথা জানালেন গুলিস্তান থেকে লালবাগ পথের একটি হিউম্যান হলারের (লেগুনা) চালক মো. রাকিব। বললেন, ‘রাস্তায় খিদা লাগলে কিছু খাওয়া মানেই ছিল কলা-রুটি। এখন কলা-রুটি খাইতেও ২০ থেকে ২৫ টাকা লাগে। লগে চা-বিড়িসহ ৪০ টাকার মতো বিল হইয়া যায়। এখন খরচ বাঁচাইতে বাইরে একবারের বেশি নাশতা করি না। মাথায় চিন্তা ঘুরে ৪০ টাকার লগে আর ২০ টাকা দিলে এক কেজি চাল হয়ে যায়। ’
তিন বেলা খাবার জোটানো সম্ভব হইব না
গুলিস্তান-ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় প্রায় ১০ বছর ধরে বাদাম বিক্রি করেন রমজান আলী। মঙ্গলবার দুপুরে বঙ্গবাজার মোড়ে কথা প্রসঙ্গে রমজান বললেন, ‘আগে সকালে ৩০ টাকায় নাশতা সারতাম, এখন আর হয় না, সে জায়গায় ৪০ থেকে ৫০ টাকা চলে যায়। দুপুরের খাবারও মোটামুটি খাইতে গেলে ১০০ টাকা চলে যায়। এভাবে জিনিসপত্রের দাম বাড়তে থাকলে তিন বেলা খাবার জোটানো সম্ভব হইব না আমাদের। ’
রমজানের স্ত্রী ও দুই সন্তান থাকে গ্রামের বাড়ি গাইবান্ধায়। রমজান থাকেন পুরান ঢাকার আলুবাজারের একটি মেসে। সকাল-দুপুর বাইরে হোটেল কিংবা ভ্রাম্যমাণ দোকানে খাবার খান। রমজান জানালেন, কয়েক বছর ধরে রাতের খাবার ওই এলাকার একজনের কাছ থেকে মাসিক চুক্তিভিত্তিক অগ্রিম টাকা দিয়ে খান। কিন্তু চলতি মাসে হঠাৎ করেই ৫০০ টাকা বাড়িয়ে দুই হাজার টাকা করেছে। এতে বিপাকে পড়েছেন তিনি। বললেন, ‘আমারটা বাদ, এখন শুধু পরিবারের জন্য খাবার জোগানো কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ছে। ’
এর আগে সকাল সাড়ে ৭টার দিকে রাজধানীর নতুনবাজারে ‘ভ্রাম্যমাণ শ্রমিকের হাটে’ একাধিক শ্রমিকের সঙ্গে কথা হয়। সেখানে নূরেরচালা এলাকার আলম মিয়া নামের এক দিনমজুর বলেন, ‘আমি প্রতিদিন বিভিন্ন এলাকায় কাজে যাই। আর আমার বাচ্চার মা মানুষের বাসাবাড়িতে কাজ করে। আমাদের কাজের দাম আগের মতোই আছে। অথচ বাজারে জিনিসপত্রের দামে আগুন। সংসারে মাছ-মাংস কেনা তো দূরের কথা, চাল-ডাল, আলু-ভর্তা আর সবজি কিনতেই কষ্ট হচ্ছে। ’
দিনমজুর মো. রবিউল বলেন, দুই দিন ধরে ভেণ্ডির (ঢেঁড়স) তরকারি খাই। কারণ এখন বাজারে যত সবজি আছে এর মধ্যে এর দামটা কিছু কম; ২০ থেকে ৩০ টাকা কেজিতে পাওয়া যায়। ’