নিজস্ব প্রতিবেদক: নাটোরে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) ও বেলা নেটওয়ার্কের আয়োজনে নারোদ নদী রক্ষার দাবিতে এক মাননববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়েছে। মঙ্গলবার (১১ অক্টোবর ) ১০টায় নাটোর শহরের কানাইখালীতে এ মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন নাটোর এনজিও এসোসিয়েশনের সভাপতি প্রভাতি বসাক, নিডা’র নির্বাহী পরিচালক জাহানারা বিউটি, টিআইবি’র নাটোর জেলা কার্যালয়ের ম্যানেজার মো. আমিনুল ইসলাম, নববিধান বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক জাহাঙ্গীর হোসেন মোল্লা, সাংবাদিক আখলাক হোসেন লাল, বেলা’র রাজশাহী কার্যালয়ের সমন্বয়কারী তন্ময় কুমার সান্যাল, বেলা’র নেটওয়ার্ক মেম্বার ও সাথী এনজিও’র নির্বাহী পরিচালক মো. শিবলী সাদিক, বেলা’র নেটওয়ার্ক মেম্বার ও কসমস এনজি’র নির্বাহী পরিচালক মেহেনাজ মালা প্রমুখ।
মানববন্ধনে বক্তারা বলেন, নাটোর সদর উপজেলার কাফুরিয়া ইউনিয়নে মুসাখান নদী থেকে উৎপত্তি হয়ে এই নদীটি নারোদ নাম ধারণ করেছে। প্রবাহ আঁকাবাঁকা পথ দিয়ে জালালাবাদ, কসবা, নোটাবাড়িয়া, একডালা, নাটোর পৌরসভা অতিক্রম করে বড় হরিশপুর, রতেনগোপাড়া দিয়ে প্রবাহিত হয়ে শেষ পর্যন্ত গুরুদাসপুর উপজেলার নাজিরপুর ইউনিয়নে বড়াল-নন্দকুজা নদীতে পতিত হয়েছে। নদীটির দৈর্ঘ প্রায় ১৬ কিলোমিটার। নাটোর সদর থেকে গুরুদাসপুর পর্যন্ত প্রবাহিত পথে নাটোর শহরের মধ্যে নদীটির প্রায় ৬ কিলোমিটার অংশ পড়েছে। নাটোর চিনিকলের কাছ থেকে শুরু করে শহরের মধ্যে দিয়ে সদরের কাসীমপুর শশ্মান পর্যন্ত প্রবাহিত হয়েছে এ নদী। এই নদীকে কেন্দ্র করেই এখানকার ব্যবসা-বাণিজ্য গড়ে উঠেছে। একসময় এই নদী পথে মালামাল পরিবহণ করা হতো। নদীর মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন অনেকে। গোসলসহ ঘর গৃহস্থালীর কাজে ব্যবহার হত নারোদ নদীর পানি।
কিন্তু এখন সে অবস্থা আর নাই। একদিকে যেমন প্রবাহ কমে গেছে তেমনি অন্যদিকে নদীর তীরে গড়ে ওঠা বড় বড় চারটি শিল্প প্রতিষ্ঠানসহ শহরের প্রায় সব ধরণের বর্জ্যই নদীতে গিয়ে পড়ছে। ফলে নদীর পানি দূষিত হওয়াসহ অসহনীয় গন্ধে শহরের বাতাস প্রতিনিয়ত ভারী হচ্ছে। মশা-মাছি উপদ্রব বাড়ছে। এছাড়াও নানারকম চর্ম রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন নদী পাড়ের মানুষ। এতে করে নদীর স্বাভাবিক পরিবেশ বিনষ্ট হচ্ছে, ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে এলাকার প্রতিবেশ ব্যবস্থা এবং ব্যাহত হচ্ছে নাগরীক জীবন।
নাটোরের নাগরিক সমাজের আবেদনের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) নারোদ নদী দূষণ-দখল থেকে মুক্ত করাসহ নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ নিশ্চিত করার দাবিতে মহামান্য হাইকোর্টে একটি রিট পিটিশন (রিট নং ৭৩২/২০১৪) দায়ের করে। উক্ত রিট পিটিশনের শুনানী শেষে নাটোর শহরের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া নারোদ নদীর প্রবাহ বাধাগ্রস্থ করে এমন সব স্থাপনা অপসারণ এবং নদীতে বর্জ্য নিস্কাশনের ও পানি দূষণের সব ধরণের দূষকের উৎস হতে নদীকে রক্ষা করতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবেনা তা জানতে চেয়ে বিবাদীদের প্রতি আদালত রুল জারি করেন। একইসাথে নারোদ নদীতে সব ধরণের বর্জ্য ফেলার নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য নাটোরের একডালাস্থ ‘প্রাণ এগ্রো লিমিটেড’ এর জেনারেল ম্যানেজারকে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। এবং নারোদ নদীতে বর্জ্য ফেলা ও নদীর পানি দূষণ হয় এমন ঘটনা এবং নদীর প্রবাহ বিঘ্নিত করে এমন কার্য্ক্রম বন্ধ হয়েছে কিনা তা নজরদারী করে প্রতিবেদন দাখিল করতে পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, নাটোরের জেলা প্রশাসক, পরিবেশ অধিদপ্তর রাজশাহী বিভাগের পরিচালক এবং নাটোর সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। এছাড়াও ‘প্রাণ এগ্রো লিমিটেড’ কর্তৃক নদীতে বর্জ্য ফেলার কারণে যে ক্ষতি হয়েছে তা মূল্যায়নপূর্বক নাটোরের একডালাস্থ ‘প্রাণ এগ্রো লিমিটেড’ এর জেনারেল ম্যানেজার এর নিকট থেকে আইন অনুযাযী ক্ষতিপূরণ আদায় করতে পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে আদালত নির্দেশ প্রদান করেছেন।
আদালত নারোদ নদীর প্রবাহ বিঘ্নকারী সকল স্থাপনা অপসারণের আদেশ দিলেও নাটোর সদরের একডালায় প্রাণ এগ্রো লিমিটেড কর্তৃক নির্মিত মাত্র একটি স্থাপনা অপসারণ করা হয়েছে। বাকি ৩৬টি স্থাপনা অপসারণের কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। দখল-দূষণের কারণে নারোদ আজ একটি মৃত নদীতে পরিণত হয়েছে। ফলে নদীর মাছসহ অন্যান্য জলজ প্রাণী বিলুপ্ত প্রায়। সেই সাথে বিনষ্ট হচ্ছে শহরের স্বাভাবিক পরিবেশ। কিন্তু আদালতের নির্দেশনা থাকা স্বত্বেও সংশ্লিষ্ট প্রশাসন নারোদের দখল-দূষণ রোধে তেমন কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। মানববন্ধন থেকে দখল অবমুক্ত করা, দূষণ বন্ধ করা, সিএস ম্যাপ অনুযায়ী নদীর সীমানা নির্ধারণসহ নারোদের প্রবাহ নিশ্চিত করার জোর দাবি জানানো হয়।
মানববন্ধনে কৃষক, মৎস্যজীবী, শিক্ষক, সাংবাদিক, শিক্ষার্থী, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, ব্যবসায়ী, এনজিও প্রতিনিধিসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার প্রায় শতাধিক নারী-পুরুষ অংশগ্রহণ করেন।
ইউকে/এসএম