স্নিগ্ধা ইসলাম: কদম, কেয়া আর কেতকীর নয়নাভিরাম রূপের পসরা ও পেখম খোলা ময়ূরের উচ্ছল নৃত্যের আবাহন নিয়ে এলো বরষা। বাংলা ষড়ঋতুর দ্বিতীয়টি বর্ষা। অপরূপ রূপবতী মেঘবতীকে সঙ্গে করে আসা বর্ষার সেই প্রথম দিন আজ। আষাঢ়ের প্রথম দিন আকাশের চিরচেনা সেই ঝরঝর শব্দে রিনিঝিনি বর্ষার আগমন ঘটবে কীনা তা বলা যায় না। কিন্তু বর্ষণ হোক বা নাই হোক, আজ পহেলা আষাঢ়। যেমন বলেছেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার আবেগময় গানে- ‘বাদল দিনের প্রথম কদমফুল করেছ দান, আমি দিতে এসেছি শ্রাবণের গান।’ আর পঞ্জিকার অনুশাসন অনুযায়ী অন্তত নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, আজ আষাঢ়স্য প্রথম দিবস।
আষাঢ়ে প্রকৃতি রূপ-রঙে হয়ে ওঠে ঢল ঢল। তাপদাহে চৌচির মাঠ-ঘাট খাল-বিল বনবিথিকায় জেগে ওঠে নবীন প্রাণের ছন্দ। সময়-অসময়ে ঝমাঝম বৃষ্টি, কর্দমাক্ত পথঘাট, চারিধারে অথৈ থৈ থৈ পানিতে আবহমান বাংলার রূপ হয় অপরূপ রূপবতী সলিল দুহিতা। ফুলে ফুলে শোভিত হয় প্রকৃতি। তাল তমাল শাল পিয়াল আর মরাল কপোতের বন বীথিকায় চোখে পড়ে বকুল, কদম, জারুল, পারুল, কৃষ্ণচূড়া ও রাধাচূড়াসহ অসংখ্য ফুল।
আষাঢ়-শ্রাবণ এ দু’মাস বর্ষাকাল। ইতিমধ্যে গত কয়েকদিন থেকে ঘনিয়ে আসা মেঘপুঞ্জ আর বৃষ্টির মধুর বিড়ম্বনা বর্ষার আগমন বার্তা অবশ্য দেশবাসীকে জানিয়ে দিয়েছে। রিমঝিম বর্ষায় দীঘল কর্মহীন দিবস-রজনীতে উদাস মনের তোলপাড়ে ঘরে বসে গ্রামীণ নারীর কখনও কাঁথা সেলাই, কিংবা তরুণ মনে তপ্ত দীর্ঘশ্বাসে দু’জনাকে মুখোমুখি করে এই বর্ষা। আবহমান বাংলার চিরায়ত বর্ষার রূপ-রস এবং সৌন্দর্য ও প্রকৃতি বিচারে আরও বলা যায়, তাপবিদগ্ধ তৃষিত ধরা নববর্ষার সিঞ্চনে সিক্ত হওয়ার দিন এসেছে।
বাঙালির প্রেমকাতর হৃদয় নব-বরিষার ছোঁয়ায় সিক্ত হওয়ার পাশাপাশি হবে আরও সমৃদ্ধ। বৃষ্টির শব্দে মহাকবি কালিদাসের যক্ষ্মের মতোই বাঙালির হৃদয় এক অজানা বিরহে ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। আর তাই বর্ষা হয়ে উঠেছে ঋতুর রানী। এই বর্ষার আগমনে প্রেমিক কবিরাও আবহমানকাল ধরেই উচ্ছলিত-বিচলিত। বাঙালি অনেক বিখ্যাত কবির প্রিয় ঋতু বর্ষা। বাংলা ভাষার অমর কাব্য ‘মেঘদূত’-এর মহাকবি কালিদাস তো এই আষাঢ়স্য প্রথম দিবসেই বিরোহী যক্ষ্ম মেঘকে দূত করে সুদূর দুর্গম কৈলাশ শিখরে পাঠিয়েছিলেন বিরোহিনী প্রিয়ার কাছে। তিনি এই আষাঢ়েই চিরায়ত কাব্যগ্রন্থ মেঘদূত রচনা করেন।
প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ দাশ আষাঢ়কে বলেছেন ‘ধ্যানমগ্ন বাউল-সুখের বাঁশি।’ অন্যদিকে মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত লিখেছেন ধ্রুপদী সেই পঙ্ক্তি- ‘গভীর গর্জন করে সদা জলধর/উথলিল নদ-নদী ধরণীর উপর।’ বাঙালির অতি প্রিয় এই ঋতুর আগমনে পুরো প্রকৃতি তার রূপ ও বর্ণ বদলে ফেলে। গাছপালা, তরুলতা সবকিছুই যেন গ্রীষ্মের দহন থেকে পরিতৃপ্তি পেতে স্নান করে ওঠে। পেখম মেলে নৃত্য করে ময়ূর। আষাঢ় যেন প্রকৃতির এক আশীর্বাদ। কবিগুরুর কাব্যভাণ্ডারের বহু ছত্রে কেবল বর্ষা আবাহনের পঙ্ক্তি : ‘হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে, ময়ূরের মতো নাচেরে, আকুল পরান আকাশে চাহিয়া উল্লাসে কারে যাচে রে।’
কিংবা ‘নীল নবঘনে আষাঢ় গগনে/তিল ঠাঁই আর নাহিরে/ওগো আজ তোরা/যাসনে ঘরের বাহিরে।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘আষাঢ়সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো, গেল রে দিন বয়ে/বাঁধনহারা বৃষ্টিধারা ঝরছে রয়ে রয়ে।’
বর্ষা নিয়ে নবযৌবন আর যৌবনের কবিদের অমরগাথা থাকলেও একে নিয়ে আবার অনুযোগেরও কমতি নেই। কাব্যলক্ষ্মীর সাধনায় যাদের আগ্রহ কম তাদের অনেকের কাছে বর্ষা ভোগান্তিরও বটে। কেননা আষাঢ় মানেই বৃষ্টির ঘনঘটা। বৃষ্টির তোড়ে যাওয়া যায় না ঘরের বাইরে।
বিশেষ করে নগরে রাস্তায় বের হওয়া অনেক সময়ে চরম দুর্ভোগই নিয়ে আসে। কমে যায় দিনমজুরের আয়-উপার্জন। গ্রামাঞ্চলেও অনেক সময়ে কাজে ব্যাঘাত ঘটে। তবে বর্ষা নিয়ে যাই চলুক আর ঘটুক প্রকৃতির গভীর আহ্বান ও নিষ্ঠুর বাস্তবতার মধ্যে সমন্বয় করেই চলছে বাঙালি মনন।
ইউকে/এসই/এসএম