বার্তাকক্ষ প্রতিবেদন: ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ, আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ ও ইস্কাটন গার্ডেন উচ্চবিদ্যালয়। তিনটিই রাজধানীর বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বাংলা মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানগুলোতে ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে মাসিক টিউশন ফি নেওয়া হয় যথাক্রমে ১ হাজার ৪০০, ১ হাজার ৪৫০ ও ৪৫০ টাকা। ভর্তিসহ অন্যান্য ফির ক্ষেত্রেও কোনো সামঞ্জস্য নেই। যে প্রতিষ্ঠান যেভাবে পারছে ফি আদায় করছে। এ চিত্র সারা দেশের।
দেশে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফি নির্ধারণে কোনো আইন, নিয়ম বা নীতিমালা নেই। এর ফলে অনেক প্রতিষ্ঠান অতিরিক্ত বেতনসহ অন্যান্য ফি আদায় করছে বলে অভিযোগ করেন অভিভাবকেরা। এসব ফি আদায় বন্ধে একাধিকবার নির্দেশনাও দিয়েছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়। কিন্তু তাতেও লাগাম টানা সম্ভব হয়নি।
এ সমস্যা সমাধানে চার বছরের বেশি সময় আগে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের টিউশন ফি-সংক্রান্ত নীতিমালা করার উদ্যোগ নেয় সরকার। কিন্তু এখনো চূড়ান্ত হয়নি নীতিমালাটি। কবে নাগাদ নীতিমালাটি চূড়ান্ত করে কার্যকর করা যাবে, তা স্পষ্ট করে বলছে না কেউ।
নীতিমালার সর্বশেষ অবস্থা জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের যুগ্ম সচিব (বেসরকারি মাধ্যমিক অধিশাখা) সোনা মনি চাকমা বলেন, ‘নীতিমালার খসড়া করা হয়েছে। আশা করছি, খুব শিগগির নীতিমালাটি চূড়ান্ত করা হবে।’
দীর্ঘদিন ধরে টিউশন ফি নীতিমালা কার্যকর না হওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেছেন শিক্ষাবিদেরা। তাঁদের ভাষ্য, এ উদ্যোগ কার্যকর হলে দেশের শিক্ষা খাতে শৃঙ্খলা ফিরে আসবে।
জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির সদস্য শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. একরামুল কবির আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘শিক্ষানীতি, ২০১০-এ বিষয়টি (টিউশন ফি নীতিমালা করা) উল্লেখ ছিল। সরকার কার স্বার্থে জনকল্যাণমূলক এমন বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে না, তা বোধগম্য নয়। বিষয়টি হতাশাজনক।’
বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) ২০২১ সালের তথ্য অনুযায়ী, দেশে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরের ৩৬ হাজার ৭১০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৩৪ হাজার ৮১৬টিই বেসরকারি।
জানা যায়, ২০১৮ সালের জেলা প্রশাসক সম্মেলনে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে টিউশন ফি নীতিমালা করার জন্য কয়েকজন জেলা প্রশাসক প্রস্তাব দেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৮ সালের ২০ নভেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের উপসচিব আনোয়ারুল হক খসড়া নীতিমালা পাঠানোর জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে অনুরোধ করেন। এরপর নীতিমালার খসড়া করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ নীতিমালার আওতায় এমপিওভুক্ত ও নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাসিক বেতন, ভর্তি, সেশন, বোর্ড পরীক্ষার ফরম পূরণসহ মোট ২৬ ধরনের ফি নির্ধারণ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর বাইরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কোনো অতিরিক্ত অর্থ আদায় করতে পারবে না। আদায় করা অর্থ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাধারণ তহবিলে জমা রাখতে হবে এবং নির্দেশনা মোতাবেক খরচ করতে হবে।
জানা গেছে, খসড়া নীতিমালায় মহানগর, পৌর জেলা/পৌর উপজেলা এবং মফস্বলের স্কুল ও কলেজের জন্য আলাদা টিউশন ফি নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে দুটি ভাগ রয়েছে। একটি এমপিওভুক্ত ও অন্যটি নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে এমপিওভুক্ত মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণিতে মাসিক বেতন সর্বনিম্ন ১০০ থেকে সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। আর নবম-দশম শ্রেণিতে মাসিক বেতন ১৫০ থেকে ৪০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। আর নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নবম-দশম শ্রেণিতে মাসিক বেতন ২৫০ থেকে ৬০০ টাকা এবং ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণির বেতন ২০০ থেকে ৫০০ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
একইভাবে কলেজ পর্যায়ে এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাসিক বেতন সর্বনিম্ন ১৮০ থেকে সর্বোচ্চ ৪৫০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ ছাড়া স্নাতক পর্যায়ে এ হার ২০০ থেকে ৫০০ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে এ হার কলেজ পর্যায়ে ৩০০ থেকে ৬০০ টাকা করা হয়েছে। আর স্নাতক পর্যায়ে ৪০০ থেকে ৭০০ টাকা রাখার কথা বলা হয়েছে খসড়া নীতিমালায়।
এ ছাড়া নীতিমালায় অভ্যন্তরীণ পরীক্ষা, টিফিন, ম্যাগাজিন, ক্রীড়া, সাংস্কৃতিক উৎসব, ধর্মীয় অনুষ্ঠান, লাইব্রেরি, পরিচয়পত্র, নবীনবরণ, শিক্ষা সফর, উন্নয়ন ফি ইত্যাদি খাতে কত টাকা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আদায় করতে পারবে, এ বিষয়েও নির্দিষ্ট করা হয়েছে। এই ফি সর্বনিম্ন ৫ থেকে সর্বোচ্চ ২০০ টাকা।
নীতিমালায় রসিদ বই ছাড়া শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে কোনো অর্থ আদায় করা যাবে না বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়, প্রতিষ্ঠানের নির্ধারিত রসিদ বই ছাড়া কোনো অর্থ আদায় করা যাবে না এবং শিক্ষার্থীদের রসিদ প্রদান করতে হবে। বিল, ভাউচার ছাড়া কোনো ব্যয় করা যাবে না।
বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফি নির্ধারণে নীতিমালার বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. এস এম হাফিজুর রহমান বলেন, ‘এটা করা খুব জরুরি। কারণ, আমাদের এক প্রতিষ্ঠান থেকে আরেক প্রতিষ্ঠানে খরচের ফারাক খুব বেশি। এটা করলে বাণিজ্যিক চিন্তা থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার যে প্রবণতা সমাজে তৈরি হয়েছে, তা বন্ধ হবে। একই সঙ্গে শিক্ষা খাতে শৃঙ্খলা ফিরে আসবে।’
ইউকে/এএস