বার্তাকক্ষ প্রতিবেদন: একজন সেনা কাঁধে নিয়েই জ্যাভেলিন মিসাইল দিয়ে লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালাতে পারে। এক বছর আগে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন যখন ইউক্রেনে তার বাহিনী পাঠান, তখন অধিকাংশ পর্যবেক্ষক মনে করেছিলেন— অল্প সময়ের মধ্যে লক্ষ্য অর্জন করবে মস্কো। এমনকি পুতিন প্রশাসনও প্রত্যাশা করেছিল— এক সপ্তাহ কিংবা সর্বোচ্চ এক মাসের মধ্যে ইউক্রেনে তাদের লক্ষ্য অর্জিত হবে।
রাশিয়ার সাফল্যের ব্যাপারে প্রাথমিক সেই ভবিষ্যদ্বাণীগুলো বাস্তবায়িত হয়নি। এর পেছনে ইউক্রেনীয়দের উচ্চতর মনোবল এবং সামরিক কৌশলসহ বিভিন্ন কারণ, বিশেষ করে পশ্চিমা অস্ত্র সরবরাহকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
যদিও সাম্প্রতিক সময়ে যুদ্ধের ফলকে প্রভাবিত করার মতো পশ্চিমা যুদ্ধ ট্যাংক বা প্যাট্রিয়ট এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমগুলো ইউক্রেনের জন্য অনেক সম্ভাবনা তৈরি করেছে, তবে এসব সিস্টেম এখনো চলমান যুদ্ধে ব্যবহার করা হয়নি।
তবে অন্যান্য কিছু অস্ত্র রয়েছে, যা ইতোমধ্যে যুদ্ধের গতিপথ পরিবর্তন করতে সহায়তা করেছে। সে রকম তিনটি মূল অস্ত্র সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন। ইউক্রেনীয়রা এগুলো ব্যবহারের মাধ্যমে শক্তিশালী রুশ বাহিনীকে কোণঠাসা করতে পেরেছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
জ্যাভেলিন: রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যকার যুদ্ধে সরাসরি ক্রেমলিনের সঙ্গে সংঘর্ষে যেতে নারাজ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা শক্তিগুলো। এর বদলে বিভিন্ন অস্ত্রশস্ত্র ও অর্থ সহায়তার মাধ্যমে মিত্র ইউক্রেনের হাত শক্ত করার কৌশল নিয়েছে তারা। ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনীর কাছে যে মার্কিন অস্ত্রের সবচেয়ে বেশি চাহিদা, সেটি হলো— জ্যাভেলিন অ্যান্টি-ট্যাংক মিসাইল সিস্টেম। সংক্ষেপে যাকে জ্যাভেলিন মিসাইল বলে। কাঁধে জ্যাভেলিন ক্ষেপণাস্ত্র লঞ্চার নিয়ে ইউক্রেনীয় সৈন্যদের ছবি সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে অনেক আগেই।
ইউক্রেন যুদ্ধের শুরুর দিকে দেশটির রাজধানী কিয়েভের দিকে দ্রুত অগ্রসর হচ্ছিল রুশ বাহিনী। ধারণা করা হচ্ছিল, খুব অল্প সময়ের মধ্যে কিয়েভে পৌঁছে যাবে পুতিন (রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন) বাহিনী। রাশিয়ান বাহিনীকে ওই সময় ঠেকিয়ে দিতে তাই ইউক্রেনের জন্য এমন কিছু অস্ত্রের প্রয়োজন ছিল, যা প্রতিপক্ষের অগ্রগতিকে থামিয়ে দিতে পারবে। সে কাজটিই সুচারুরূপে করতে পেরেছে জ্যাভেলিন ক্ষেপণাস্ত্র।
যৌথভাবে ক্ষেপণাস্ত্রটি তৈরি করেছে মার্কিন কোম্পানি লকহিড মার্টিন ও রেথিয়ন। জ্যাভেলিন মিসাইল একটি পোর্টেবল অ্যান্টি-ট্যাংক মিসাইল সিস্টেম। একজন সেনা একাই এটিকে কাঁধে বহন করতে এবং লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালিয়ে নিরাপদ স্থানে চলে আসতে পারে। ১৯৯৬ সাল থেকে এই অ্যান্টি-ট্যাংক মিসাইল ব্যবহার করছেন মার্কিন সেনারা। এমনকি সবচেয়ে অত্যাধুনিক বর্মও ভেদ করতে সক্ষম এই মিসাইল।
জ্যাভেলিন মিসাইলের গতিপথ হয় ধনুকের মতো বাঁকা। ফলে এটি কোনো ট্যাংক বা ভারি সাঁজোয়া যানের ওপর থেকে আঘাত করতে পারে। আর ট্যাংকের ওপরের অংশেই বর্ম থাকে সবচেয়ে পাতলা। এ কারণে জ্যাভেলিন মিসাইল বর্ম ভেদ করে ট্যাংক ধ্বংসে পারদর্শী। সাধারণত গেরিলা যুদ্ধের জন্য এটি বেশ উপযোগী।
যুক্তরাষ্ট্র তো বটেই, এ ছাড়া কাতার, ফ্রান্স, জর্ডান, আয়ারল্যান্ড ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো বিভিন্ন দেশ জ্যাভেলিন মিসাইল ব্যবহার করে। আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া ও লিবিয়ার গৃহযুদ্ধে এটি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে।
রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনীয় বাহিনীও এই ক্ষেপণাস্ত্র কার্যকরভাবে ব্যবহার করছে। যুদ্ধ শুরুর মাস দুয়েক পরই ইউক্রেনীয় সেনারা দাবি করেছিল যে, জ্যাভেলিনের আঘাতে ৫ শতাধিক রাশিয়ান ট্যাংক এবং দেড় হাজারের বেশি সাঁজোয়া যান ধ্বংস হয়েছে। অর্থাৎ ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনীর জন্য এই জ্যাভেলিন মিসাইলই হয়ে উঠে প্রতিরোধের প্রতীক।
সিএনএন বলছে, জ্যাভেলিন মিসাইল ব্যবহারের আরেকটি সুবিধা হলো এটি রাজনৈতিকভাবেও গ্রহণযোগ্য। এ বিষয়ে অন্টারিওর ব্রক বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক মাইকেল আর্মস্ট্রং দ্য কনভারসেশনে (অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক বিশ্লেষণধর্মী মিডিয়া) লিখেছিলেন, কম খরচ এবং প্রতিরক্ষামূলক ব্যবহারের কারণে জ্যাভেলিন মিসাইলগুলো অন্য দেশগুলোর জন্য সরবরাহ করা সহজ।
হিমার্স : এই ক্ষেপণাস্ত্রটিরও প্রস্তুতকারক ও স্বত্বাধিকারী মার্কিন কোম্পানি লকহিড মার্টিন। এটির পুরো নাম এম১৪২ হাই মোবিলিটি আর্টিলারি রকেট সিস্টেম, সংক্ষেপে হিমার্স। হিমার্স হলো একটি পাঁচ টন ওজনের ট্রাক, যেখানে থাকে একটি উৎক্ষেপণ ব্যবস্থা। এটি একই সঙ্গে প্রায় ৬টি রকেট ছুড়তে পারে। এই ক্ষেপণাস্ত্রের সুবিধা হলো— এটি যুদ্ধক্ষেত্রের সম্মুখ সারিতে হামলা চালিয়ে দ্রুত অবস্থান বদল করে ফেলতে পারে, যাতে পাল্টা হামলা এড়ানো যায়।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে হিমার্স সম্পর্কে সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের আন্তর্জাতিক নিরাপত্তাবিষয়ক কর্মসূচির জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা মার্ক কানসিয়ান লেখেন, ইউক্রেন যুদ্ধের শুরুর দিকে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে জ্যাভেলিন মিসাইল। পরবর্তীতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে হিমার্স মিসাইল।
হিমার্স থেকে ছোড়া রকেটগুলো রকেট ৭০-৮০ কিলোমিটার দূরত্বের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে। হিমার্স যে যুদ্ধাস্ত্র ছোড়ে, সেগুলোকে গাইডেড মাল্টিপল লঞ্চ রকেট সিস্টেম বা জিএমএলআরএস নামে অভিহিত করা হয়। জিপিএস সিস্টেমের মাধ্যমে পরিচালিত হওয়ার কারণে অত্যন্ত নিখুঁতভাবে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে হিমার্স।
রুশ সাংবাদিক রোমান সাপেনকভ গত জুলাইয়ে এ সম্পর্কে বলেছিলেন, তিনি ইউক্রেনের খেরসন বিমানবন্দরে থাকা একটি রুশ ঘাঁটিতে হিমার্স রকেট সিস্টেম দিয়ে হামলার ঘটনা দেখেছেন। ওই সময় খেরসন এলাকাটি নিয়ন্ত্রণ করতো রুশ বাহিনী। তিনি আরও লিখেছেন, ওই হামলার দৃশ্য দেখে আমি হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। কারণ ছোট একটি জায়গার ওপর একসঙ্গে ৫ থেকে ৬টি রকেট এসে পড়েছে।
হিমার্স সিস্টেম নিয়ে ইসরাইলের ডিফেন্স ফোর্সেস কমান্ড অ্যান্ড স্টাফ কলেজের অধ্যাপক ইয়াজিল হেনকিন বলেছেন, রুশ বাহিনীর বিরুদ্ধে হিমার্স দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছে। হিমার্সের নিখুঁত হামলার কারণে গোলাবারুদের ভান্ডার সরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছিল রুশ বাহিনী। ফলে রুশ বাহিনীর জন্য যুদ্ধক্ষেত্রের কাছাকাছি গোলাবারুদ পাওয়াটা খুব কঠিন হয়ে পড়েছিল।
ইয়াজিল হেনকিন আরও বলেন, দীর্ঘ পাল্লার এই রকেট ব্যবহার করে ইউক্রেনীয় বাহিনী সেতুর (ব্রিজ) মতো লক্ষ্যবস্তুগুলোতে হামলা চালানোর কারণে রুশ বাহিনীর জন্য সরঞ্জাম সরবরাহ করাও কঠিন হয়ে গিয়েছিল।
বায়রাকতার টিবি২ ড্রোন: তুরস্কের তৈরি এ ড্রোনটি ইউক্রেন যুদ্ধে ব্যবহৃত হওয়ার কারণে বিশ্বে সবচেয়ে পরিচিত চালকবিহীন ড্রোনগুলোর একটিতে পরিণত হয়েছে। এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো— এগুলো অপেক্ষাকৃত দামে সস্তা। তা ছাড়া এগুলোতে হামলা তথা অভিযানের ঘটনাও ভিডিও রেকর্ড করার ব্যবস্থা আছে।
ইউক্রেন যুদ্ধে রেকর্ড করা এমনই কিছু ভিডিওতে দেখা গেছে, মানববিহীন এই যুদ্ধাস্ত্র থেকে ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্র, লেজার নিয়ন্ত্রিত রকেট এবং স্মার্ট বোমা ছুড়ে রুশ বাহিনী সাঁজোয়া যান, গোলাবারুদ এবং সরবরাহ ব্যবস্থা গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।
বায়রাকতার টিবি২ ড্রোন নিয়ে ফরেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ গবেষক অ্যারন স্টেইন লিখেছেন, এই ড্রোনে রেকর্ড করা ভাইরাল ভিডিওগুলো টিকটকের এই যুগে আধুনিক যুদ্ধ ব্যবস্থার যথার্থ দৃষ্টান্তকে তুলে ধরছে। অবশ্য বায়রাকতার টিবি২ ড্রোন কোনো জাদুর অস্ত্র নয়, তবে এটি অসম্ভব রকমের ভালো।
আটলান্টিক কাউন্সিলের ওয়েবসাইটে লেখা নিবন্ধে এই গবেষক বায়রাকতার টিবি২ ড্রোনের দুর্বল দিকও তুলে ধরেছেন। অ্যারন স্টেইন মনে করেন, তুরস্কের তৈরি এই ড্রোনটির গতি কম। তা ছাড়া আকাশ প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রেও এর সক্ষমতা কম।
তবে ড্রোনগুলোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো- এগুলো দামে সস্তা। ফলে যুদ্ধক্ষেত্রে এগুলো ধ্বংস হলেও খুব একটা যায় আসে না। কারণ দামে সস্তা হওয়ায় খুব সহজেই নতুন ড্রোন নিয়ে আসা যায়, বলেন স্টেইন।
সিএনএনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বায়রাকতার টিবি২ ড্রোন ইউক্রেনীয়দের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়। টিবি২ ড্রোন নিয়ে ইউক্রেনে তৈরি হওয়া একটি মিউজিক ভিডিওই তার প্রমাণ।”
ইউকে/এএস