বার্তাকক্ষ প্রতিবেদন: নানা ধরনের সুবিধা আর ছাড় দিয়ে গত বছর খেলাপি ঋণের লাগাম কিছুটা টানা গেলেও আবার তা বাড়তে শুরু করেছে। চলতি বছরের প্রথম তিন মাসেই ব্যাংকিং খাতে খেলাপি বেড়েছে প্রায় ছয় হাজার ৩৫১ কোটি টাকা।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, করোনাভাইরাস মহামারির কারণে ঋণের কিস্তি শোধ না করলেও খেলাপি করা যাবে না—২০২০ সালজুড়ে এমন সুবিধা পেয়েছে ঋণগ্রহীতারা। এতে গত বছর ঋণের কিস্তি না দিয়েও নতুন করে কেউ খেলাপি হয়নি। সেই হিসাব ধরে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ কিছুটা কমে আসে। চলতি বছর এই সুবিধা বহাল রাখা হয়নি। তবে সব ধরনের ঋণের কিস্তি ও সুদ পরিশোধের মেয়াদ বিভিন্ন হারে বাড়ানো হয়েছে। তার পরও খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে গেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত মার্চ মাস শেষে দেশের ৫৯টি ব্যাংকের মোট বিতরণকৃত ঋণ দাঁড়িয়েছে ১১ লাখ ৭৭ হাজার ৬৫৮ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ ৯৫ হাজার ৮৫ কোটি ৩৫ লাখ টাকা, যা বিতরণকৃত ঋণের ৮.৭ শতাংশ। গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ছিল ১১ লাখ ৫৮ হাজার ৭৭৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ছিল ৮৮ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা। ওই অঙ্ক ছিল মোট বিতরণ করা ঋণের ৭.৬৬ শতাংশ। এর আগে ২০২০ সালের মার্চ মাস শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৯২ হাজার ৯৬২ কোটি টাকা। এই হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে দুই হাজার ১২২ কোটি ৪৪ লাখ টাকা।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি ঋণের যে তথ্য দিচ্ছে, আসল অঙ্কটা তার আড়াই গুণ বেশি। এ ধরনের মিনিংলেস তথ্য দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেশবাসীকে বিভ্রান্ত করছে। এতে আমাদের ব্যাংকিং খাতের ভয়ানক ক্ষতি হচ্ছে। ঋণ আদায় না করে, ঋণখেলাপিদের নানা সুযোগ-সুবিধা দিয়ে কাগজে-কলমে খেলাপি কম দেখানোর মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কী মজা পাচ্ছে, তা আমার মাথায় ঢোকে না। ঋণখেলাপিদের বারবার ছাড় দিয়ে ভালো ঋণগ্রহীতাদের ঋণ পরিশোধে নিরুৎসাহ করা হচ্ছে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে আরো দেখা যায়, এ সময়ে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর ঋণ খেলাপি হয়েছে ৪৩ হাজার ৪৫০ কোটি টাকা। বেসরকারি ব্যাংকের খেলাপি ৪৫ হাজার ৯০ কোটি টাকা। বিশেষায়িত ব্যাংকের চার হাজার ৪৬ কোটি টাকা। এ ছাড়া বিদেশি ব্যাংকের দুই হাজার ৪৫৮ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ।
করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রভাব মোকাবেলায় খেলাপি ঋণের ক্ষেত্রে আরো এক দফা ছাড় দিয়ে সার্কুলার জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে বলা হয়, যেসব চলমান ঋণের মেয়াদ ইতিমধ্যে অতিবাহিত হয়েছে এবং প্রচলিত নীতিমালার আওতায় নবায়ন করা হয়নি, সেসব ঋণের বিপরীতে অনাদায়ি সুদ চলতি মার্চ থেকে আগামী বছরের জুন পর্যন্ত ছয়টি সমান ত্রৈমাসিক কিস্তিতে পরিশোধ করা যাবে। একই সঙ্গে চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে আগামী বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত আরোপিত সুদ নিয়মিতভাবে পরিশোধ করলে ওই সব ঋণকে খেলাপি করা যাবে না। অর্থাৎ চলমান ঋণের সুদ নিয়মিত পরিশোধ করলে তা খেলাপি হবে না। এই সুবিধা আগামী বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত অর্থাৎ দেড় বছর বাড়ানো হয়েছে। এবার শুধু সুদ পরিশোধ করতে হবে।
গত বছরের সুবিধায় ২০২০ সালে সুদ ও ঋণ কোনোটিই পরিশোধ করতে হয়নি। তা এ বছর থেকে পরিশোধ করতে হচ্ছে। তলবি ঋণের ক্ষেত্রে গত মার্চ থেকে আগামী বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে আটটি সমান ত্রৈমাসিক কিস্তিতে পরিশোধ করা যাবে। নিয়মিত কিস্তি পরিশোধিত হলে এগুলোকে ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত খেলাপি করা যাবে না। এ ক্ষেত্রে মেয়াদ বেড়েছে ২১ মাস।
সার্কুলারে আরো বলা হয়, ‘নিয়মিত কিস্তি পরিশোধিত না হলে যে ত্রৈমাসিকে কিস্তি পরিশোধিত হবে না, ওই সময় থেকেই আলোচ্য সুবিধা বাতিল বলে গণ্য হবে। একই সঙ্গে ওই ঋণকে খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করা যাবে। চলমান, তলবি ও মেয়াদি ঋণের বিপরীতে চলতি মার্চ পর্যন্ত প্রদেয় কিস্তি ব্যাংক-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে আগামী ৩০ জুনের মধ্যে পরিশোধ করা হলে সেগুলোকে খেলাপি করা যাবে না। এ ক্ষেত্রে মেয়াদ বেড়েছে তিন মাস।
ইউকে/এসএম