মুফতি মুহাম্মাদ ইসমাঈল: শবেবরাতে যারা মহান আল্লাহর কাছে ক্ষমা, দয়া, রিজিক ইত্যাদি চাইবে তাদের চাওয়া পূরণ করা হবে। তবে এ রাতে মুশরিক ও হিংসুককে খাঁটি তাওবা না করলে ক্ষমা করা হবে না, তাদের চাহিদাও পূরণ করা হবে না। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ মধ্য শাবানের রাতে (বিশেষভাবে) আত্মপ্রকাশ করেন এবং মুশরিক ও হিংসুক ব্যতীত তাঁর সৃষ্টির সবাইকে ক্ষমা করেন।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ১৩৯০)
কারো ভালো কিছু বা উন্নতি দেখে তার বিলুপ্তি কামনাকে বলা হয় হাসাদ বা হিংসা, যা জায়েজ নয়। নবীজি (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘তোমরা পরস্পর বিদ্বেষ পোষণ কোরো না। হিংসা কোরো না। ষড়যন্ত্র কোরো না। সম্পর্ক ছিন্ন কোরো না। তোমরা সবাই আল্লাহর বান্দা ও ভাই ভাই হয়ে যাও।’ (বুখারি, হাদিস : ৬০৭৬)
তবে কারো ভালো কিছু বা উন্নতি দেখে তার বিলুপ্তি কামনা না করে নিজেও তা অর্জনের চেষ্টা করাকে বলা হয় গিবতা বা ঈর্ষা, যার উৎসাহ দেওয়া হয়েছে।
ইবলিস শয়তান হিংসা ও অহংকারের কারণে আদম (আ.)-কে সেজদা না করে বিতাড়িত হয়েছে। আদমপুত্র হাবিলের কোরবানি কবুল হওয়ায়, হিংসাবশত কাবিল তাঁকে খুন করে প্রথম অন্যায় খুনকারী হয়েছে। ইউসুফ (আ.)-এর ভাইয়েরা হিংসা করে তাঁকে কূপে ফেলে নিন্দার পাত্র হয়েছে। এ ছাড়া অসংখ্য-অগণিত মানুষ হিংসার রোগে আক্রান্ত হয়ে নানা অপরাধে জড়িয়েছে-জড়াচ্ছে।
মুনাফিকের স্বভাব হিংসা করা। হিংসার কারণে তারা ঈমানদারদের উন্নতিতে নাখোশ হয়। ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমাদের (ঈমানদারদের) কোনো কল্যাণ হলে তারা অসন্তুষ্ট হয়। আর তোমাদের কোনো অকল্যাণ হলে তারা আনন্দিত হয়।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত : ১২০)
প্রকৃত মুমিনের স্বভাব—অন্যের কল্যাণ কামনা করা, অকল্যাণ কামনা থেকে বিরত থাকা। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের কেউ প্রকৃত মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না সে তার ভাইয়ের জন্য সেটাই পছন্দ করবে, যা তার নিজের জন্য পছন্দ করে।’ (বুখারি, হাদিস : ১৩)
হিংসা ও ঈমান একত্র হয় না
পূর্ণ ঈমানদারের অন্তরে হিংসা থাকবে না, হিংসুকের অন্তরে পূর্ণ ঈমান থাকবে না। পূর্ণ মুমিন কখনো হিংসুক হয় না, হিংসুক কখনো পূর্ণ মুমিন হয় না। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘কোনো বান্দার অন্তরে ঈমান ও হিংসা একত্র হতে পারে না।’ (নাসায়ি, হাদিস : ৩১০৯)
হিংসা দ্বিনের বিনাশকারী
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের আগেকার উম্মতের রোগ তোমাদের মধ্যেও সংক্রমিত হয়েছে। তা হলো পরস্পর হিংসা-বিদ্বেষ ও ঘৃণা। আর এই রোগ মুণ্ডন করে দেয়। আমি বলছি না, চুল মুণ্ডন করে দেয়; বরং এটা দ্বিন মুণ্ডন তথা বিনাশ করে দেয়। (তিরমিজি, হাদিস : ২৫১০)
হিংসা নেকি বিলীনকারী
নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা অবশ্যই হিংসা পরিহার করবে। কারণ আগুন যেভাবে কাঠ বা ঘাস খেয়ে ফেলে, তেমনি হিংসাও মানুষের নেক আমল খেয়ে ফেলে।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৪৯০৩)
হিংসুক অন্যের ভাগ্যে আপত্তিকারী
মহান আল্লাহ যাকে যে নিয়ামত দেন তা নিজ অনুগ্রহ ও ইচ্ছায়-ই দেন। তার ভাগ্যে যা আছে তা-ই দেন। কেউ কারো নিয়ামতে হিংসা করা—তাকদির বা ভাগ্যে আপত্তি করার নামান্তর। ইরশাদ হয়েছে, ‘…আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে মানুষকে যা দিয়েছেন সে জন্য কি তারা তাদের হিংসা করে?’ (সুরা নিসা, আয়াত : ৫৪)
শ্রেষ্ঠ মানুষ কে
আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, একদা রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে জিজ্ঞেস করা হলো শ্রেষ্ঠ মানুষ কে? তিনি বললেন, ‘প্রত্যেক বিশুদ্ধ অন্তরের অধিকারী ও সত্যভাষী ব্যক্তি’। লোকেরা বলল, সত্যভাষীকে তো আমরা চিনতে পারি। কিন্তু বিশুদ্ধ অন্তরের অধিকারী ব্যক্তি কে? জবাবে তিনি বললেন, ‘সে হলো আল্লাহভীরু। পরিচ্ছন্ন হৃদয়ের অধিকারী যার কোনো পাপ নেই। সত্যবিমুখতা নেই। বিদ্বেষ নেই, হিংসা নেই।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৪২১৬)
হিংসামুক্ত ব্যক্তিকে জান্নাতের সুসংবাদ
আনাস ইবনে মালেক (রা.) বলেন, আমরা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে বসা ছিলাম। এমন সময় তিনি বলেন, ‘এখন তোমাদের কাছে একজন জান্নাতি মানুষের আগমন ঘটবে।’ অতঃপর আনসারদের এক ব্যক্তি আগমন করল। যার দাড়ি দিয়ে অজুর পানি টপকাচ্ছিল ও তার বাম হাতে জুতা জোড়া ছিল। দ্বিতীয় দিন ও তৃতীয় দিন রাসুল (সা.) একই রূপ বললেন এবং পরক্ষণে একই ব্যক্তির আগমন ঘটল। অতঃপর যখন রাসুল (সা.) মজলিস থেকে উঠলেন, তখন আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনিল আস (রা.) তার পিছু নিলেন। …আনাস (রা.) বলেন, আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) বলেন, আমি তার বাসায় তিন রাত কাটাই। কিন্তু তাকে রাতে নামাজের জন্য উঠতে দেখিনি, কেবল ফজরের জন্য অজু করা ব্যতীত। তবে আমি তাকে সর্বদা ভালো কথা বলতে শুনেছি। এভাবে তিন দিন তিন রাত চলে গেলে আমি তার আমলকে সামান্য মনে করতে লাগলাম। আমি তখন ওই ব্যক্তিকে বললাম, আপনার সম্পর্কে রাসুল (সা.) এই এই কথা বলেছিলেন এবং আমিও আপনাকে গত তিন দিন ধরে দেখছি। কিন্তু আপনাকে বড় কোনো আমল করতে দেখলাম না! তাহলে কোন বস্তু আপনাকে ওই স্থানে পৌঁছিয়েছে, যার সুসংবাদ আল্লাহর রাসুল (সা.) আমাদের শুনিয়েছেন? তিনি বললেন, আমি যা করি তা তো আপনি দেখেছেন। অতঃপর যখন আমি চলে আসার জন্য পিঠ ফিরাই, তখন তিনি আমাকে ডেকে বললেন, ‘আপনি যা দেখেছেন, তা তো দেখেছেন। তবে আমি আমার অন্তরে কোনো মুসলিমের প্রতি কোনোরূপ বিদ্বেষ রাখি না এবং কারো প্রতি আল্লাহপ্রদত্ত কোনো কল্যাণের কারণে হিংসা পোষণ করি না।’ এ কথা শুনে আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) বললেন, ‘এটিই আপনাকে উক্ত স্তরে পৌঁছিয়েছে। এটি এমন এক বস্তু, যা আমরা করতে পারি না।’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ১২৬৯৭)। আল্লাহ সবাইকে হিংসার রোগ থেকে আরোগ্য দান করুন। আমিন
লেখক : মুহাদ্দিস, জামিয়া আম্বরশাহ আল ইসলামিয়া, কারওয়ান বাজার, ঢাকা