ড. এম মেসবাহউদ্দিন সরকার: চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রতিযোগিতায় বিশ্বব্যাপী চলছে প্রযুক্তি খাতের আলোড়ন, উন্নয়ন ও উদ্ভাবন। এ ধারায় বর্তমানে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় রয়েছে ব্লকচেইন প্রযুক্তি, যা মূলত তথ্য সংরক্ষণে নিরাপদ ও উন্মুক্ত পদ্ধতি হিসাবে বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। আধুনিক বিশ্বে ডিজিটাল মুদ্রায় লেনদেনে তথ্যভান্ডারের নিরপত্তার জন্য ২০০৮ সালে ব্লকচেইন উদ্ভাবন করেন বিটকয়েনের প্রতিষ্ঠাতা সাতোশি নাকামোতো। ক্রিপ্টোকারেন্সি অ্যালগরিদম ব্যবহার করে তথ্যের নিরাপত্তা বিধান করা হয় ব্লকচেইন পদ্ধতিতে। ব্লকচেইন পদ্ধতি এমন একটি ডিজিটাল প্ল্যাটফরম, যেখানে সমস্যার সমাধান হয় কোনো রকম বিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠান বা কেন্দ্রীয় সার্ভারের সাহায্য ছাড়াই। এর অর্থ, ব্লক দিয়ে তৈরি চেইন বা ব্লকের চেইন। অনেকগুলো ব্লককে একটির সঙ্গে আরেকটি জোড়া দেওয়ার মাধ্যমে ব্লকের একটি শিকল তৈরি করাই হচ্ছে ব্লকচেইন। যে ব্লকগুলো দিয়ে এ চেইনটি তৈরি করা হয়, সেগুলো মূলত তথ্য সংরক্ষণ করে। এটি একটি ডিস্ট্রিবিউটেড লেজার, যা সবার জন্য উন্মুক্ত। ব্লকচেইনের ব্লকগুলোর মধ্যে যখন একটি তথ্য ইনপুট দেওয়া হয়, তখন ওই তথ্য ডিলিট করা বা ডেটাটির কোনো ধরনের পরিবর্তন করা প্রায় অসম্ভব। সম্পূর্ণ ব্লকচেইনের প্রতিটি সিঙ্গেল ব্লকে মূলত তিনটি জিনিস থাকে-ডেটা, হ্যাশ ও চেইনে তার আগের ব্লকটির হ্যাশ। অর্থাৎ ব্লকচেইনের প্রতিটি ব্লকে থাকে সেই ব্লকটির নিজস্ব ডেটা, ব্লকটির নিজের হ্যাশ এবং ঠিক তার পেছনে যুক্ত থাকা আগের ব্লকটির হ্যাশ। হ্যাশিং হলো ডেটা সুরক্ষার জন্য ক্রিপটোগ্রাফিক টেকনিক, যা ডেটাকে অতি গোপনীয়তার সঙ্গে সুরক্ষার জন্য এর স্ট্রাকচার পরিবর্তন করে রাখার বিশেষ কৌশল বা অ্যালগরিদম। হ্যাশ পদ্ধতি ব্যবহার করে কোনো ডেটাকে একবার পরিবর্তন করা হলে তা আর মূল ডেটায় রূপান্তর করা সম্ভব হয় না।
ব্লকচেইনের ডিস্ট্রিবিউটেড লেজারে লেনদেনের তথ্য হ্যাক করা, দুর্নীতি করা বা সিস্টেমে প্রতারণা করাও প্রায় অসাধ্য। এ লেনদেনগুলো ব্লকচেইনে কম্পিউটার সিস্টেমের সম্পূর্ণ নেটওয়ার্কের সঙ্গে বিতরণ ও রেকর্ড করা হয়। অন্যভাবে বললে, এটি একটি বিকেন্দ্রীভূত বিতরণ নেটওয়ার্ক, যা বিভিন্ন ব্লকে একটির পর একটি চেইন আকারে সংরক্ষণ করে। যখনই ব্লকচেইনে কোনো নতুন লেনদেন হয় তখনই তার রেকর্ড প্রত্যেক অংশগ্রহণকারীর লেজারে চলে যায়। অর্থাৎ এতে তথ্য মালিকানা সংরক্ষিত থাকে। কারও পক্ষে এ মালিকানা পরিবর্তন করা সম্ভব নয়, কারণ প্রত্যেক লেনদেন রিয়েল টাইমে নথিভুক্ত করা হয়; যা সবার কাছে পৌঁছে যায় সময়মতো। এভাবে গোটা প্রক্রিয়াকে সবার কাছে স্বচ্ছ করে তোলে। যদি কেউ এতে সংশোধন বা বদলানোর চেষ্টা করে, তাহলে তাকে বিতরণ সংস্করণের চেইনের প্রতিটি ব্লক পরিবর্তন করতে হয়, যা কার্যত অসম্ভব। শুধু তাই নয়, খাতায় থাকা এ লেনদেনগুলো মালিকের ডিজিটাল স্বাক্ষর দ্বারা অনুমোদিত হয়, ফলে এটা আরও স্বচ্ছ হয়। এ কারণে সিস্টেমে কেউ বদল বা পরিবর্তনের চেষ্টা করলে সেটা দ্রুত শনাক্ত করা যায়। এটি একটি বিকেন্দ্রীভূত পিয়ার-টু-পিয়ার নেটওয়ার্ক সিস্টেম, যার দায়িত্বে কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তি নেই, যে অন্যান্য কেন্দ্রীভূত ও ঐতিহ্যবাহী লেনদেনের মতো লেনদেন পরিচালনা বা নিয়ন্ত্রণ করবে। কোনো রকম তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপ বা মধ্যস্থতা ছাড়া এ প্রযুক্তিতে কার্য সম্পাদন হয়। তারা এটা ব্যবহার করে শুধু তাদের পারস্পরিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতে। ফলে গ্রাহককে এ কাজের জন্য কমিশন বাবদ কোনো খরচ করতে হয় না। প্রচলিত যে কোনো লেনদেনে মধ্যস্থতাকারীর কাছে সব কার্যক্রমের রেকর্ড, নিরীক্ষণ ইত্যাদি সংরক্ষণ থাকে এবং এতে হ্যাকাররা গোটা প্রক্রিয়াটাকে দুর্বল করার সুযোগ পায়। কিন্তু ব্লকচেইন টেকনোলজিতে মধ্যস্থতাকারীর প্রয়োজন হয় না, কারণ এটা এন্ড-টু-এন্ড প্রযুক্তি। এটা এমনই একটি ডিজিটাল লেজার, যার রেকর্ডগুলো সহজে টেম্পার করা বা মুছে ফেলা যায় না। শুধু তাই নয়, এটা লেনদেনকে দ্রুত, স্বচ্ছ ও নিরাপদ করে তোলে।
বিগত কয়েক বছরে মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসেছে ব্লকচেইন প্রযুক্তি। এটি পরবর্তী প্রজন্মের জন্য একটা প্রতিশ্রুতিশীল ও বৈপ্লবিক প্রযুক্তি, যা দ্রুত বিকাশ লাভ করছে দেশের শিক্ষা, ব্যাংকিং, সাপ্লাই চেইন, হেলথকেয়ার, বাণিজ্য, কৃষি, রিয়েল এস্টেট ও ভূমি ব্যবস্থাপনাসহ সব সেক্টরে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নির্বাচনে ভোটিং সিস্টেমে ব্লকচেইন টেকনোলজি ব্যবহার করতে দেখা যাচ্ছে। এ প্রযুক্তিতে দক্ষতা অর্জনের জন্য দেশের ১৫০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশেষায়িত ল্যাব, ৩০০টি স্কুল অব ফিউচার, ৬৪টি জেলায় শেখ কামাল আইটি ট্রেনিং অ্যান্ড ইনকিউবেশন সেন্টার, সারা দেশে ৮ হাজার শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব এবং আরও ১০টি ল্যাব প্রতিষ্ঠা করা হবে। এতে কর্মসংস্থান হবে দশ লক্ষাধিক ফ্রিল্যান্সারসহ অসংখ্য তরুণ-তরুণীর। এভাবে ক্রমেই দেশের মেধাবী, শিক্ষার্থী, তরুণ-তরুণীরা ব্লকচেইন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, বিগ ডেটা অ্যানালাইটিকস, মেশিন লার্নিংয়ের মতো ফ্রন্টিয়ার (অত্যাধুনিক) প্রযুক্তিতে দক্ষ হয়ে উঠছে। পাশাপাশি ২০২০ সালে সিটি ইউনিভার্সিটি হংকং ও হংকং ব্লকচেইন সোসাইটির যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত আন্তর্জাতিক ব্লকচেইন অলিম্পিয়াড (আইবিসিওএল)-২০২০ প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের ১২টি দলসহ যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, চীনসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ৬০টি দল অংশগ্রহণ করে। বাংলাদেশ দুটি আন্তর্জাতিক পুরস্কার অর্জন করে। সাফল্যের ধারাবাহিকতায় ২০২১ ও ২০২২ সালে দেশেই অনুষ্ঠিত হয় ‘ব্লকচেইন অলিম্পিয়াড বাংলাদেশ’। এ বছর (২০২৩) চতুর্থবারের মতো আয়োজিত হয়েছে এ প্রতিযোগিতা। এবারের প্রতিযোগিতায় ১১৮টি দল থেকে ৪০টিকে চূড়ান্ত পর্বে মনোনীত করা হয়। তিনদিনের এ আয়োজনে অনলাইনে চারটি সেমিনারসহ দেশি-বিদেশি অনেক ব্লকচেইন বিশেষজ্ঞ অংশগ্রহণ করেন।
‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ তৈরির লক্ষ্যে ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ এমন একটি পর্যায়ে পৌঁছাবে, যেখানে প্রত্যেক জনশক্তিই হবে স্মার্ট, সবার হাতে থাকবে ডিজিটাল ডিভাইস, সহজলভ্য হবে উচ্চগতির ইন্টারনেট, সব লেনদেন হবে ক্যাশলেস এবং গঠিত হবে পেপারলেস সোসাইটি অর্থাৎ সমগ্র জাতি; আর বিশ্ব নিমজ্জিত হবে অসীম ডেটা সমুদ্রের তলদেশে। ডেটাই হবে তখন পরিচয়ের একমাত্র ধারক ও বাহক। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ এ তথ্যের ডেটাবেজ ও এর স্ট্রাকচার, প্রক্রিয়া ও সরবরাহ যদি সুরক্ষিত না হয়, তাহলে সবকিছুই চলে যাবে হ্যাকারদের দখলে। গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বব্যাপী প্রতিদিন লক্ষাধিক সাইবার হামলার ঘটনা ঘটে এবং এর ঊর্ধ্বমুখী গ্রাফ আশঙ্কাজনক। ২০২০ সালে বৈশ্বিক সাইবার হামলার সংখ্যা ছিল ৩০৪ দশমিক ৬ মিলিয়ন, ২০২১ সালে এ সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল ৬২৩ দশমিক ৩ মিলিয়নে এবং ২০২২ সালে এই হামলা বেড়েছিল ৩৮ শতাংশ। মাত্র কিছুদিন আগেও বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষের তথ্য ফাঁস হয়েছে বলে জানিয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকার একটি সংস্থা। তাই আগামীতে স্মার্ট হওয়ার যাত্রাপথে তথ্যের গোপনীয়তা ও নিরাপত্তার বিষয়টি যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনই সাইবার হামলার আশঙ্কা আরও বাড়বে এটিও মাথায় রাখতে হবে। এ অবস্থায় তথ্যের লেনদেন সুসংহত ও নিরাপদ রাখার জন্য ব্লকচেইন পদ্ধতি খুবই সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। ব্লকচেইন ইতোমধ্যেই ‘ডিজরাপ্টেড টেকনলোজি’ হিসাবে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং চতুর্থ শিল্পবিপ্লব অর্জনের লক্ষ্যে বিশ্বের চতুর্থ দেশ হিসাবে জি-ক্লাউডে যুক্ত হচ্ছে। আশা করা যাচ্ছে, ভিশন ২০৪১-এর লক্ষ্য অর্জন এবং তথ্য আদান-প্রদান এবং সব লেনদেনে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিন্তে ব্লকচেইন প্রযুক্তি হবে বিশ্ববাসীর আস্থার জায়গা। আর এ কাজ উপযোগী দক্ষ মানুষ সম্পদ ও টেকসই অবকাঠামো তৈরিতে সম্মুখ সারিতে থাকবে বাংলাদেশ।
ড. এম মেসবাহউদ্দিন সরকার : অধ্যাপক ও তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়