ফুলেফেঁপে উঠেছে রাজশাহীর মন্ত্রী-এমপিদের সম্পদ

নিজস্ব প্রতিবেদক: রাজশাহীর ৬টি সংসদীয় আসনের বর্তমান সংসদ সদস্যদের সম্পদ, আয় এবং অর্থ গত ৫ বছরে অনেক বেড়ে গেছে। শুধু তাই নয়, নিজেদের সম্পদ ও অর্থ বাড়ার পাশাপাশি সম্পদ বেড়েছে তাদের স্ত্রীদেরও। এমনকি তাদের অধিকাংশ এখন কোটিপতি। এ ছাড়া তাদের মধ্যে অনেকের রয়েছে একাধিক বিলাসবহুল গাড়ি ও বাড়িও। আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে মনোনয়নপত্রের সঙ্গে জমা দেওয়া হলফনামা থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।

রাজশাহী-১ আসনের এমপি ফারুকের ব্যাংকে প্রায় ৯ কোটি টাকা

আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে দাখিল করা হফলনামায় রাজশাহী-১ (তানোর-গোদাগাড়ী) আসনের সংসদ সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরী উল্লেখ করেছেন, অস্থাবর সম্পত্তির মধ্যে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে তার মোট ৮ কোটি ৯৭ লাখ ৩৮ হাজার ৬০৬ টাকা জমা আছে। নিজের, স্ত্রী এবং নির্ভরশীলদের হাতে নগদ টাকা রয়েছে ১ কোটি ২৬ লাখ ৫৮ হাজার ৪৪৬ টাকা। অথচ ২০১৮ সালের হলফনামায় এমপি ফারুক ও তার স্ত্রীর নগদ অর্থসহ ব্যাংকে জমা ছিল মাত্র ১ কোট ২৪ লাখ ৯২ হাজার ৭১৬ টাকা। ২০১৮ সালে বন্ড, ঋণপত্র, স্টক একচেঞ্জ শেয়ারে কোনো টাকা না থাকলেও তার এবং পরিবারের এবার রয়েছে ১৪ লাখ ১৩ হাজার টাকা। এবার পোস্টাল সঞ্চয়পত্র ২ লাখ টাকা। স্থাবর সম্পত্তির মধ্যে নিজ নামে পৈতৃকভাবে প্রাপ্ত ৬০ বিঘা কৃষি জমি রয়েছে। ২০১৮ সালের হলফনামায় পরিবারের নির্ভরশীলদের নামে কোন কৃষি জমি না থাকলেও এবার রয়েছে ৬০ বিঘা জমি।

টাকা ও সম্পদে এগিয়ে রাজশাহী-২ (সদর) আসনের এমপি বাদশাও

এই আসনে পরপর তৃতীয় মেয়াদ আওয়ামী লীগের টিকেটে সংসদ সদস্য হন বাংলাদেশের ওয়ার্কাস পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা। এবার নৌকা প্রতীক না পেলেও নিজ দলের হয়েই মনোনয়ন জমা দিয়েছে। গত তৃতীয় মেয়াদে এমপি বাদশাও স্থাবর, অস্থাবর সম্পদ ও নগদ অর্থে টাকার কুমির বনে গেছেন। শুধু গত ২০১৮ সালের হলফনামা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, নগদ ও ব্যাংক মিলে অর্থ ছিল ৪১ লাখ ১৬ হাজার ৪৮৬ টাকা। এ ছাড়াও স্ত্রীর নগদ টাকা ও সেভিংস মিলে ৮ লাখ ৪০ হাজার টাকা। দুটি গাড়ির দাম দেখানো হয় ৫৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা।

অথচ এবারের দাখিলকৃত হলফনামায় দেখা যায়, তার নগর ও ব্যাংক মিলে মোট অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ কোটি ৫৬ লাখ ৬৩ হাজার ২৪৫ টাকা। এর বাইরে একটি ৭০ লাখ টাকার জিপ গাড়ি রয়েছে। পাশাপাশি বাড়ির আসবাবপত্র দেখানো হয়েছে ৪ লাখ টাকার। এ ছাড়া, খন্দকার মার্কেট ও উত্তরায় ৫ কাঠা জমিও নিয়েছেন তিনি।

এমপি হয়ে শত বিঘা জমির মালিক রাজশাহী-৩ (পবা-মোহনপুর) আসনের এমপি আয়েন

রাজশাহী-৩ আসনে ২০১৪ সালে প্রথমবারের মতো এমপি নির্বাচিত হন আয়েন উদ্দিন। নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই প্রতি মেয়াদেই বেড়েছে অর্থ ও জমি। মাত্র ২ বিঘা জমি থেকে গত ১০ বছরে জমির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭৭ বিঘায়। ছাড়াও হয়েছে বাড়ি, গাড়ি ও ঢাকায় ফ্লাট। পাশাপাশি ৭৭ দশমিক ৭৯ একর জমি লিজ নিয়েও করছেন মাছ চাষ।

২০১৮ সালে এমপি আয়েন উদ্দিনের হলফনামায় দেখা যায়, তার নগদ অর্থ ছিল ৩ লাখ টাকা। এ ছাড়াও ৪৩ লাখ ৮২ হাজার ৯২২ টাকা ছিল ব্যাংকে। তার স্ত্রীর নগদ ও ব্যাংক মিলিয়ে ছিল ৫ লাখ ৭৯ হাজার ৬৯১ টাকা। এর বাইরে সঞ্চয়পত্র ছিল ১৫ লাখ টাকার। জীবন বিমা ছিল ২ লাখ ১৯ হাজার ৩০০ টাকার। ২০১৮ সালে তিনি ঢাকায় তিন কাঠা জমি কেনেন। এর বাইরে স্ত্রীর নামে ১টি ফ্লাট কেনেন। অথচ এবার নির্বাচন অফিসে জমা দেয়া হলফনামায় দেখা গেছে, এমপি আয়েন উদ্দিনের জমি দেখানো হয়েছে ৭৭ বিঘা। ফলে গত পাঁচ বছরে তার জমি বেড়েছে ৭৫ বিঘা। এ ছাড়াও পূর্বাচলে ৩ কাঠা জমি রয়েছে তার। এর বাইরে ৭৭ দশমিক ৭৯ একর জমিতে লিজ নিয়ে মাছ চাষ দেখানো হয়েছে। পাশাপাশি তার স্ত্রীর নামে আছে দুইটি ফ্লাট।

পেশা ব্যবসা দেখালেও আয় শূন্য, এমপি হয়েও এনামুল করেন চাকরি

রাজশাহী-০৪ (বাগমারা) আসনের তিনবারের সংসদ সদস্য ইঞ্জিনিয়ার এনামুল হক নিজে এনা গ্রুপের মালিক। আসন্ন সংসদ নির্বাচনে লড়তে তার জমা দেওয়া হলফনামায় তিনি পেশা দেখিয়েছেন ব্যবসা। অথচ এই ব্যবসা থেকে তার ১ টাকাও আয় নেই বলে উল্লেখ করেছেন। অথচ তিনি এমপি হয়েও চাকরি থেকে বছরে ৩২ লাখ ৩ হাজার ৪৬ টাকা আয় করেন বলে উল্লেখ করেছেন হলফনামায়। ২০১৮ সালে শেয়ার, সঞ্চয়পত্র ও ব্যাংক আমানত হিসেবে তার কোনো টাকা না থাকলেও এবার এই খাতে বাৎসরিক আয় দেখিয়েছেন ৫৫ লাখ ৬১ হাজার ৮৪২ টাকা। এমপি এনামুল ও তার স্ত্রীর হাতে ও ব্যাংক হিসাবে ৭১ লাখ ৬৯ হাজার ১২০ টাকা দেখালেও নিজের নামে রয়েছে ৩টি বিলাসবহুল গাড়ি (গাড়ি ৩টির মূল্য মোট ৩ কোটি ৬৬ লাখ ২৭ হাজার ৮০২ টাকা)। উল্লেখ্য, নানা অনিয়মের কারণে এবার এমপি এনামুল দলীয় মনোনয়ন পাননি। তারস্থলে বাগমারার তাহেরপুর পৌরসভা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অধ্যক্ষ মো. আবুল কালাম আজাদকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। কালামের দাখিলকৃত হলফনামায় তিনি অস্থাবর সম্পত্তির মধ্যে নগদ ১০ লাখ, ব্যাংকে ৫০ হাজার এবং পোস্টাল সেভিংস সঞ্চয়পত্রে নিজের নামে ২৯ লাখ ২৪ হাজার ৯৫৭ টাকা এবং স্ত্রীর নামে দেখিয়েছেন ২০ লাখ টাকা। তার রয়েছে একটি মোটরসাইকেল ৩৩ লাখ ৬৫ হাজার ৬০৭ টাকা মূল্যের একটি মাইক্রোবাস এবং ১ কোটি ১৩ লাখ ২০ হাজার টাকা মূল্যের একটি হার্ড জিপ গাড়ি।

রাজশাহী-৫ আসনের এমপি মনসুর গড়েছেন অর্থ ও সম্পদের পাহাড়

রাজশাহী-০৫ (পুঠিয়া-দুর্গাপুর) আসনের সংসদ অধ্যাপক ডা. মনসুর রহমান ২০১৮ সালে নির্বাচন কমিশনে হলফনামায় নিজের ব্যাংক হিসাব নম্বরে ৩ লাখ ১১ হাজার ১২৫ টাকা দেখালেও এবার তার ব্যাংক হিসাবে রয়েছে ২ কোটি ১৯ লাখ ৯৭ হাজার ১৭৬ টাকা পোস্টাল সেভিংস সার্টিফিকেটসহ বিভিন্ন ধরনের সঞ্চয়পত্রে ২০১৮ সালের হলফনামায় ৩৫ লাখ টাকা উল্লেখ করলেও এবার এই খাতে তার বিনিয়োগ ২ কোটি ৪৬ লাখ ৯৭ হাজার ৭৬৭ টাকা। স্থাবর সম্পত্তি হিসেবে ২০১৮ সালে ৩০ লাখ টাকা মূল্যের কৃষি জমি থাকলেও এবার দেখিয়েছেন সাড়ে ৩২ বিঘা কৃষি জমি এবং ৬ বিঘার পুকুর। উল্লেখ্য, আসন্ন নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পাননি এই এমপি। তার স্থলে সাবেক এমপি ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কাজী আব্দুল ওয়াদুদ দারাকে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। দারার দাখিলকৃত হলফনামা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে- নিজের, স্ত্রী এবং নির্ভরশীলদের হাতে এবং ব্যাংকে রয়েছে ২ কোটি ৬৭ লাখ ৬৫৩ টাকা। এ ছাড়া তাদের বন্ড, ঋণপত্র, স্টক একচেঞ্জ শেয়ারে রয়েছে ৭ কোটি ৪ লাখ ২৫ হাজার টাকা। তার ও পরিবারের পোস্টাল সঞ্চয়পত্র বা স্থায়ী আমানতে বিনিয়োগ রয়েছে ৩ কোটি ৭৬ লাখ ৮৫ হাজার ৭৯২ টাকা।

পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের নগদ ও ব্যাংক ব্যালেন্স বেড়েছে ৩ গুণ

পেশায় ব্যবসায়ী রাজশাহী-৬ (বাঘা-চারঘাট) আসনের সংসদ সদস্য ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। আসন্ন সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে তার দাখিলকৃত হলফনামা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০১৮ সালের চেয়ে শাহরিয়ার এর নগদ ও ব্যাংকে গচ্ছিত টাকার পরিমাণ বেড়েছে তিন গুণের বেশি। এবার তার দাখিলকৃত হলফনামায় দেখা গেছে, তার নগদ ও ব্যাংকে গচ্ছিত টাকার পরিমাণ ২১ কোটি ৪৫ লাখ ৪৯ হাজার ১৭৩ টাকা। অথচ ৫ বছর আগে এই টাকার পরিমাণ ছিল ৬ কোটি ৭৮ লাখ ৯ হাজার ৭০৬ টাকা। স্ত্রী ও দুই ছেলের নগদ ও ব্যাংক হিসাবে রয়েছে ২ কোটি ৬ লাখ ২০ হাজার, ৯৮৫ টাকা। এমপি শাহরিয়ার আলমের বিভিন্ন কোম্পানিতে শেয়ারের মাধ্যমে বিনিয়োগ রয়েছে ৬৬ কোটি ৪১ লাখ ৩২ হাজার ৭০০ টাকা। এ ছাড়া তার সঞ্চয়পত্রে আমানতে বিনিয়োগ রয়েছে ৩০ লাখ টাকা। নিজের রয়েছে ১ কোটি ১লাখ ৩ হাজার ১০০ টাকা মূল্যের লাক্সারি একটি কার। এ ছাড়া স্ত্রীর নামে ১ কোটি ১৬ লাখ ২৫ হাজার ৫৭৫ টাকা মূল্যের একটি গাড়ি। নিজের নামে ৭৫ হাজার টাকা সমমূল্যের স্বর্ণ এবং স্ত্রীর নামে ১৭৫ ভরি স্বর্ণ (যার আনুমানিক মূল্য ১ কোটি ৪০ লাখ টাকা) রয়েছে। শাহরিয়ার আলমের স্থাবর সম্পত্তির মধ্যে রয়েছে- ১.৭৯৬৫ একর কৃষি জমি এবং অকৃষি জমির পরিমাণ ১৫.৩৯৪ একর। এমপি শাহরিয়ারের ঢাকার গুলশানে রয়েছে দুটি অ্যাপার্টমেন্ট এবং নিজ এলাকা বাঘার আড়ানিতে রয়েছে চারতলা বিশিষ্ট একটি বাড়ি।

ইউকে/এএস/আরএ