বার্তাকক্ষ প্রতিবেদন: মূল্যস্ফীতির চাপে যখন মানুষ হাঁসফাঁস করছে। তখন রমজান ঘিরে আগেভাগেই বাড়ানো হচ্ছে ফলের দাম। দুই সপ্তাহের ব্যবধানে খুচরা পর্যায়ে এক লাফে কেজিতে ২০ থেকে ৬০ টাকা বেড়েছে প্রায় সব ফলের দাম। ঋণপত্র খোলায় জটিলতা, ডলারের দাম বৃদ্ধি, শুল্ক বাড়ানো ও সরবরাহে ঘাটতি কারণে চাহিদার তুলনায় ফল আমদানি কমছে। এতে বাড়ছে ফলের দাম বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। একইসঙ্গে ভোক্তারা বলছেন আমদানিকারকরা বিদেশি ফল বাজারে কম ছাড়ছেন এবং বাড়তি দামে বিক্রি করে সুবিধা নিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। এ কারণেই রোজা আসার আগেই দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
আমদানিকারকরা বলছেন, ফলের আমদানি কমে যাওয়ায় তাদের ব্যবসাও কমেছে। ডলারের বাড়তি দাম ও শুল্ক বাড়ায় আমদানি কমার কারণে বাজারে ফলের দাম ১০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। এজন্য অনেকে মুনাফা কমিয়ে ব্যবসায় টিকে থাকার চেষ্টা করছেন। আবার অনেক আমদানিকারক বড় ক্ষতির শঙ্কায় আমদানি বন্ধ করে দিয়েছেন। কিছুদিন আগে নাশপাতি ও ছোট কমলার শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। এতে ওই দুটি ফলের দাম বেড়েছে। কিন্তু অন্য ফলগুলোতে আগের মতোই আমদানি শুল্ক রয়েছে। এতে দুটি ফল ছাড়া অন্যগুলোর দাম বাড়ার কোনো কারণও দেখছেন না তারা।
শনিবার (০৯ মার্চ) রাজধানীর সবচেয়ে বড় ফলের আড়ত বাদামতলী ও খুচরা বাজার সূত্রাপুর, রায়সাহেব বাজার, সদরঘাট ও এর আশেপাশের এলাকা ঘুরে জানা গেছে, প্রায় সব ফলের দাম গত ১৫ দিনের ব্যবধানে ২০ থেকে ৬০ টাকা বেশি দামে বিক্রি করছেন বিক্রেতারা। কমলা, মাল্টা, আঙুর ও আপেলের দাম বেড়েছে কেজিতে ৫০-৬০ টাকা পর্যন্ত। আমদানি ফলের মধ্যে কমলা, মাল্টা, আঙুর ও আপেলের চাহিদা সবচেয়ে বেশি। এই চার ফলের দামই এখন বাড়তি। তবে বিদেশি ফলের বাজার চড়া হওয়ায় দেশি ফল সেই বাজার দখল করছে বলে জানালেন ব্যবসায়ীরা।
বাদামতলীর ফলের পাইকারি বাজার ঘুরে দেখা যায়, ১৮ কেজির কার্টন আপেল পোল্যান্ড ৪ হাজার ৩০০ টাকা ছিল গত ১৫ দিন আগে সেটা বেড়ে এখন ৪ হাজার ৭০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সবুজ আপেল প্রতি কার্টন ৪ হাজার ৩০০ টাকা থেকে বেড়ে ৫ হাজার ২০০ টাকা। রয়েল গালা আপেল ১৮ কেজি ৫ হাজার ৭০০ টাকা। চায়না ফুজি আপেল প্রতি কার্টন ৪ হাজার ৫০০ থেকে ৫ হাজার টাকা। হানি ফুজি আপেল কার্টন ৩ হাজার ছিল এখন ৩ হাজার ৫০০ টাকা। মালটা প্রতি কার্টন ২ হাজার ৬০০ থেকে বেড়ে এখন ৪ হাজার ২৫০ টাকা। কালো আঙুর ২০ কেজির প্রতি কার্টন ৪ হাজার ৬০০ টাকা বেড়ে ৬ হাজার ৬০০ টাকা।
সবুজ আঙুর ২০ কেজির প্রতি কার্টন ৩ হাজার ৮০০ থেকে বেড়ে এখন ৪ হাজার ৩০০ টাকা। কমলা ২৪ কেজির প্রতি কার্টন ৩ হাজার ৭০০ টাকা থেকে বেড়ে ৪ হাজার ৭০০ টাকা। নাশপাতি এক হাজার ৯০০ টাকা থেকে বেড়ে ২ হাজার ১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আনার প্রতি কেজি ২৬০ টাকা বেড়ে ৩০০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে। নাগফল ৯ কেজির প্রতি কার্টন ২ হাজার থেকে ২ হাজার ২০০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে।
এ বিষয়ে বাদামতলী ফলের আড়ত হাজি আফছার করিম সুপার মার্কেটের ব্যবসায়ী মো. শাওন বলেন, গত দুই সপ্তাহ ধরে ফলের দাম বেড়েছে। মালটা, নাশপাতি, কমলা, আপেল, আনার ও আঙুর আমদানি করে নিয়ে আসতে হয়। যা ডলারের দামের সঙ্গে ওঠানামা করবে এটা স্বাভাবিক। কিন্তু হঠাৎ করে ফল আমদানিতে শুল্ক বাড়িয়ে দিয়েছে। তারপর ডলার সংকট। পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে এলসি খুলতে চায় না ব্যাংকগুলো। সেই সঙ্গে আছে অন্যান্য ভ্যাট ও কর।
এতে বিদেশি ফল আমদানি অনেকটা কমেছে। রমজানে চাহিদা বেশি থাকে কিন্তু আমদানি কম হওয়ায় ও শুল্ক বাড়ায় দাম বেড়েছে। এখানে সরকারের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার নালে সাধারণ মানুষের ফল খেতে অনেক কষ্ট হবে বলে জানান তিনি।
ফল ব্যবসায়ী মো. আবুল কালাম বলেন, কাস্টমস কর্তৃপক্ষ যুক্তিসংগত কারণ ছাড়াই আমদানি করা বিদেশি ফলের ওপর শুল্কহার বাড়িয়ে ফলের বাজারকে অস্থির করে তুলেছে। বিশেষ করে আগে প্রতি কেজি আপেল, কমলা এবং মাল্টায় ৬২ টাকা শুল্ক আদায় করলেও এখন তা ঠেকেছে ৮৮ টাকায়। একইভাবে ৯৮ টাকার আঙুরের শুল্কহার ১১৯ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। যেখানে বিদেশি ফলের ওপর নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্কহার ছিল ৩ শতাংশ, তা এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৩ শতাংশে।
রাজধানীর বিভিন্ন খুচরা বাজার ঘুরে জানা গেছে, সাউথ আফ্রিকার গালা আপেল বাজারে বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৩৪০ থেকে ৩৫০ টাকা। যা এক সপ্তাহ আগে ছিল ২৮০ থেকে ৩০০ টাকা কেজি। বেড়েছে ৫০ থেকে ৬০ টাকা। চীনা ফুজি আপেল বিক্রি হচ্ছে ২৮০ থেকে ৩০০ টাকা। আগে ছিল ২২০ থেকে ২৪০ টাকা। বেড়েছে ৫০ থেকে ৬০ টাকা। মালটা বিক্রি হচ্ছে ২৮০ থেকে ৩০০ টাকা কেজি। যা ছিল ২৪০ থেকে ২৫০ টাকা। বেড়েছে ৫০ টাকা। কমলা মানভেদে প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ২৪০ থেকে ২৬০ টাকা। যা ছিল ১৮০ থেকে ২২০ টাকা, বেড়েছে ৪০ টাকা
নাশপাতি ২২০ থেকে ২৪০ টাকা ছিল। এখন বিক্রি হচ্ছে ২৬০ টাকা কেজি। বেড়েছে ২০ থেকে ৪০ টাকা। মানভেদে সাদা আঙুর বিক্রি হচ্ছে ২৩০ থেকে ২৪০ টাকা কেজি, যা ছিল ২১০ থেকে ২২০ টাকার মধ্যে। বেড়েছে ২০ টাকা। মানভেদে কালো আঙুরের দাম ছিল ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা কেজি। এখন বিক্রি হচ্ছে ৩৪০ থেকে ৩৫০ টাকা কেজি। বেড়েছে ৪০ থেকে ৫০ টাকা। ছোট ও মাঝারি আনার কেজিতে প্রায় ৪০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা কেজি।
এছাড়া দেশি ফলের মধ্যে গত সপ্তাহে যে আনারস বিক্রি হয়েছে ৪০ টাকায়, আজকে সেটি বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকায়। বড় বেল (বেলি বেল) গত সপ্তাহে ১০০-১২০ টাকায় বিক্রি হলেও আজকে এটির দাম ২০০ থেকে ২৫০ টাকা। অন্য ধরনের বেল যা আগে ছিল ৫০ থেকে ৭০ টাকা সেটি বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ১২০ টাকায়। জাম্বুরার দাম গত সপ্তাহে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা হলেও আজ বিক্রি হচ্ছে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকায়।
গত সপ্তাহে পাকা পেঁপের দাম ছিল ৬০ থেকে ৮০ টাকা, আজ বিক্রি হচ্ছে ১২০ থেকে ১৬০ টাকায়। পেয়ারার দাম ছিল ৫০ থেকে ৭০ টাকা এখন বিক্রি হচ্ছে ৯০ থেকে ১০০ টাকায়। তরমুজ গত সপ্তাহে কেজি ৫০ টাকা করে বিক্রি হলেও এখন বিক্রি হচ্ছে ৭০ টাকায়। এছাড়া সফেদা ১০০ টাকা থেকে বেড়ে ১৫০ টাকায়, সবরি কলা ডজন ৮০-১০০ টাকা থেকে বেড়ে ১১০ থেকে ১৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া সাগর কলা, চম্পা কলা, বাংলা কলাসহ প্রতিটির দাম ডজনে ১০-২০ টাকা বেড়েছে।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী রবিউল বলেন, অসুস্থ ছেলের জন্য ফল কিনতে এসে হিমশিম খেতে হচ্ছে। আপেলের দাম ৩৫০, মালটা ৩০০, নাশপাতি ২৬০ কমলা ৩৫০ টাকা, আনার ৩৫০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। এত দাম দিয়ে কিনে খাওয়ানোর সামর্থ্য আমার নেই। তাই পেয়ারা কিনে নিয়ে যাচ্ছি। কি করবো ভাই। সব জিনিসের দাম বাড়ে কিন্তু আমাদের আয়তো বাড়ে না। আর এখন কেন এত দাম বাড়বে। করোনা শেষ, ডলারের দাম সেতো কবে থেকে একই আছে, যুদ্ধও একই অবস্থায় রয়েছে তাহলে নতুন করে কি হলো যে-সব কিছুর দাম বাড়বে। আসলে রোজাকে পুঁজি করে কিছু ব্যবসায়ী অতিমুনাফা নেওয়ার চেষ্টা করছে।
সদরঘাটে ফল কিনতে আসা হাজী মো. লাল মিয়া শেখ বলেন, দুই দিন পর রোজা। আর দাম বাড়ছে সবকিছুর। তাই আগেই কিছু ফল কিনে রেখেছি যাতে আরও দাম বাড়লে একটু টাকা বাঁচানো যায়। বিদেশি ফলের না হয় শুল্ক বাড়ছে। কিন্তু দেশি ফলের কি বাড়লে যে দাম বাড়াতে হবে আসলে সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেই বাজার। যে যেভাবে পারছে লুটে খাচ্ছে।
এ বিষয়ে সদরঘাট টার্মিনালের সামনে গত ৪০ বছর ধরে খুচরা ফল বিক্রি করছেন কবির হোসেন। তিনি বলেন, প্রতি বছর যেটা হয়, রোজার সময় ফলের চাহিদা বেড়ে যায়। এসময় ধনী-গরিব সবাই চেষ্টা করে ইফতারে ফল রাখতে। প্রতিবছর রোজার আগেই অল্প অল্প দাম বাড়তে থাকে। কিন্তু রোজার ২-৩ দিন আগেই মূলত দাম হুট করে বাড়ে। তবে এ বছর রোজা শুরুর ১০-১২ দিন আগেই এক লাফে পাইকারি বাজারে সব ধরনের ফলের দাম বেড়েছে।
তিনি বলেন, আড়তদাররা বলেন ফলে ডিউটি বাড়ছে তাই দাম বেশি। আমরা কি করবো বেশি দামে কিনি বেশি দামে বিক্রি করি। তবে এবছরের মতো ফলের দাম অন্য কোনো বছর এত বাড়েনি। দাম বেশি হলে ফলের চাহিদা কমে যায়। তখন যারা স্বাবলম্বী তারাই ফল বেশি কিনে। আমার কাছে মনে হয় সরকার যদি ফল আমদানিতে ডিউটি কমায় তাহলে প্রতি কার্টনে দাম ৫০০/৭০০ টাকা কমে যাবে।
সূত্রাপুর বাজারের ফল বিক্রেতা জাহাঙ্গীর বলেন, রোজার সময় অন্যান্য দেশে দাম কমে। আর আমাদের দেশে উল্টো চিত্র। রোজা এলেই পণ্যের দাম বাড়ে। গত ১০/১২ দিন ধরে দাম বেড়েছে। সব ধরনের ফলে কেজিতে প্রায় ৪০ থেকে ৫০ টাকা দাম বেড়েছে। এজন্য আমাদের বেচাকেনা কম। দাম কম থাকলে আগে যেখানে একজন লোক পাঁচ রকমের পাঁচ কেজি ফল নিতো, এখন সে দাম বেশি দেখে নিচ্ছে দুই কেজি ফল।
রায় সাহেব বাজারের ফল বিক্রেতা মো. আবাদুল বলেন, গত কয়েক দিন ধরে ফলের দাম বেড়েছে। বিশেষ করে নাশপাতি ও কমলার দাম বেশি বেড়েছে। আড়তে দাম বেশি থাকলে আমরা কি করবো। কিছু ব্যবসায়ী রোজায় মানুষ বেশি কিনবে এমন চিন্তা করে অতি মুনাফার সুযোগ নিচ্ছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুটস ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম বলেন, ফল আমদানির ওপর অতিরিক্ত কর আরোপ করা হয়েছে। এতে আমরা ফল আমদানি করতে হিমশিম খাচ্ছি। শুল্ক না কমলে এসব ফলের দাম কমার সম্ভাবনা নেই। তবে কাস্টমস কর কমালে সাধারণ মানুষ বাজার থেকে ফল কিনতে পারবে। আর সেটি নাহলে ফলের দাম নিম্ন ও মধ্যবিত্তের নাগালে আসবে না।
বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুট ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য মতে, দেশের বাজারে ৬০-৬৫ শতাংশ ফল বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। বাংলাদেশে ‘ফ্রেশ ফ্রুটস’ ও ‘ড্রাই ফ্রুটস’ এই দুই ক্যাটাগরিতে প্রায় ৫২টির মতো ফল আমদানি করা হয়। কয়েক বছর আগে দেশের ফলের বাজার ছিল আমদানি করা বিদেশি ফলের দখলে। তবে ডলার সংকটের পাশাপাশি কাস্টমস শুল্কহার বাড়িয়ে দেওয়ায় সেই আমদানি করা ফলের বাজারে ধস নেমেছে।
জানা গেছে, দেশে ৭৮ ধরনের ফল উৎপাদন হয়, এর মধ্যে ১০ থেকে ১২টি প্রধান। দেশে প্রতিবছর ফলের চাহিদা প্রায় তিন কোটি টন। এর মধ্যে পৌনে দুই কোটি টন আমদানি করতে হয়। দেশে ভারত, চীন, থাইল্যান্ড, ভুটান, ব্রাজিল, তিউনিশিয়া, আর্জেন্টিনা, তুরস্ক, পোল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, পর্তুগাল, মিসর, নিউজিল্যান্ড, আফগানিস্তান, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ফ্রান্স থেকে ফল আমদানি করা হয়। বাকি দেশে উৎপাদন করা হয়।
ইউকে/এএস