নিজস্ব প্রতিবেদক: রাজশাহী জেলার যে সব এলাকায় আদিবাসীরা বসবাস করে তার মধ্যে গোদাগাড়ী ও তানোর উপজেলা অন্যতম। এছাড়াও রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনে কিছু আদিবাসী এবং ক্ষুদ্র-নৃ-গোষ্টি বসবাস করে। তথ্য প্রাপ্তির ক্ষেত্রে আদিবাসী এবং ক্ষুদ্র-নৃ-গোষ্টির নারীরা অনেক বেশী পিছিয়ে। তথ্য না থাকার কারনে তারা সরকারী সেবা হতে বঞ্চিত হয়। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থার যথেষ্ট উন্নয়ন হয়েছে এবং দারিদ্রতা অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে। সরকারী ও বেসরকারী বিভিন্ন উদ্দ্যোগের ফলে অধিকতরহারে নারীদের অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক অংশগ্রহন বাড়ছে। সরকারী-বেসরকারী পর্যায়ে নারীদের কর্মসংস্থান হচ্ছে, একই সাথে তাদের সাংগঠনিক সক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে, জনগন বিশেষ করে নারীদের ক্ষমতায়নে বিভিন্ন আইন প্রনয়ণ করা হলেও এর সঠিক প্রয়োগের অভাবে নারীদের প্রতি সহিংসতা কোনোভাবে কমানো যাচ্ছেনা। বরং কিছু ক্ষেত্রে এর ধরণ পরিবর্তন হয়েছে।
সরকার সুশাসনের অংশ হিসেবে তথ্য অধিকার আইন ২০০৯ তৈরি করেছে। কিন্ত দারিদ্র, প্রান্তিক নারী ও দলিত সম্প্রদায় তথ্য অনুসন্ধানের পদ্ধতি সম্পর্কে জানেনা, এমনকি এই আইন সম্পর্কে কোনো ধারনা নেই। এছাড়া সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানসমুহের তথ্য সিস্টেমেটিক তথ্য ব্যবস্থাপনা ও প্রয়োজনীয় দক্ষ জনবলের অভাবে জনগন তথ্য আইনের সুফল থেকে বঞ্চিত। নারীরাও আইন মোতাবেক তথ্য সংগ্রহ করতে অণীহা প্রকাশ করে এবং নীরবতার সংস্কৃতির মধ্যে এখনো বেশিরভাগ নারী আবদ্ধ রয়েছে। দরিদ্রতার হার বেশি হওয়ায় এবং সামাজিক বিধি-নিষেধসমুহ প্রান্তিক নারীদের অধিকার নিশ্চিতে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেছে।
এসব প্রতিবন্ধকতা দুর করতে এ্যাসোসিয়েশন ফর কম্যুনিটি ডেভেলপমেন্ট (এসিডি), ইউএসএআইডি ও দি কার্টার সেন্টারের সহযোগিতায় বাংলাদেশে তথ্য প্রাপ্তির অধিকারে নারীর অগ্রগতি প্রকল্পটির মাধ্যমে নারীদের তথ্য সমৃদ্ধ করার মাধ্যমে সক্ষমতা তৈরি করার লক্ষে কাজ শুরু করে, যাতে করে নারীরা সরকারী সেবা সহজে গ্রহন করতে পারে এবং তাদের অধিকার নিশ্চিত হয়। এছাড়া দলিত সম্প্রদায় ও প্রান্তিক নারীদের জ্ঞানবৃদ্ধি, তথ্যের অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে, স্থানীয় প্রশাসন ও সরকার সংস্থা এবং কমিউনিটির নেতাদের সাথে সমন্বিতভাবে সচেতনতা বৃদ্ধিমূলক কাজ পরিচালিত করে। প্রকল্পটি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানসমুহের সাথে নিবিড়ভাবে কাজ করার মাধ্যমে তাদেরকে দরিদ্র, প্রান্তিক নারী ও বঞ্চিত জনগনের প্রতি আরো জনবান্ধব হতে সহায়তা করছে।
এর ফলে, কর্ম এলাকার নারীরা তথ্য সমৃদ্ধ হয়ে সরকারী সেবা আদায় করে নিতে শিখেছে। সরকারী বিভিন্ন অফিস হতে বিভিন্ন সেবা প্রাপ্তি নিশ্চিত করেছে। আদিবাসী নারীরা স্থানীয় ইউনিয়ন সদস্য নির্ভর ছিল, কখন ইউনিয়ন সদস্য তাদের তালিকা করে নিয়ে যাবে এবং কখন সংশ্লিষ্ট সদস্যের মুখ হতে শুনতে পাবে যে তারা সহায়তা পাবে এই আশায় বসে থাকতো। এসিডি এই তথ্য প্রাপ্তিতে নারীর অগ্রগতি প্রকল্পের কার্যক্রম শুরু করার পর আস্তে আস্তে বদলে যেতে শুরু করেছে এলাকার চিত্র। নারীরা এখন নিজে সহায়তার পাওয়ার জন্য আবেদন করে।
তথ্য অধিকার আইন ২০০৯ অনুযায়ী নারীরা সরকারী বিভিন্ন অফিসে তথ্য জানতে চেয়ে আবেদন করছে। সরকারী বিভিন্ন অফিসে খোজ নিয়ে জানা যায় অফিসগুলোতে তথ্য জানতে চেয়ে যতগুলো আবেদন জমা হয় তার ৯৫% আদিবাসী নারী ও কিশোরীদের আবেদন। তারা তথ্য পেয়ে সরকারী সেবা বা প্রশিক্ষণ গ্রহনে আগ্রহী হয়ে উঠছে। আগে বিভিন্ন প্রশিক্ষণে আদিবাসীদের খুঁজে পাওয়া যেতো না বর্তমানে বিভিন্ন প্রশিক্ষণে আদিবাসীদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।
পিছিয়ে পড়া জনগোষ্টীর মানুষ বিভিন্ন সরকারী অফিসে যোগাযোগ বাড়ছে। আগে নেতা গোছের নারীরাই শুধু বিভিন্ন অফিসে যোগাযোগ করতো। বর্তমানে অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে তারা মনে করে সরকার যেসব সেবা দিচ্ছে সেগুলো সুযোগ নয় এগুলো তাদের অধিকার। যার পরিপ্রেক্ষিতে গোদাগাড়ী উপজেলার মাটিকাটা ও গোগ্রাম ইউনিয়ন এবং তানোর উপজেলার চান্দুরিয়া ও সরনজাই ইউনিয়ন হতে মোট ১৩৮ জন নারী ভিজিডি কার্ডের জন্য সরাসরি যোগাযোগ করে উপজেলা তথ্য আপার সহযোগিতায় অনলাইনে আবেদন করেন। অনলাইনে আবেদন করে মোট ১১ জন ভিজিডি কার্ড পেয়েছে তার মধ্যে গ্রুপ সদস্যই ৮ জন, মাতৃত্বকালীন ভাতা পেয়েছে ১৫ জন, উপজেলা তথ্য আপার সহযোগিতায় নিজ এলাকায় স্বাস্থ্য ক্যাম্পের মাধ্যমে প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা পেয়েছে মোট ১১২ জন।
গোদাগাড়ী উপজেলায় ২৫ জন এবং তানোর উপজেলায় ২৫ জন আদীবাসি নারী ও কিশোরী জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে উপজেলা যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরে আবেদন করে গ্রাম পর্যায়ে ছাগল পালন প্রশিক্ষণ ও টেইলারিং প্রশিক্ষণ গ্রহন করেন। ৫ জন আদিবাসী নারী প্রতিমাসে ৩৫০০-৪৫০০ টাকা আয় করছে এবং আরো ২১ জন আদিবাসী কিশোরী প্রশিক্ষনের সাথে যুক্ত আছে তার মধ্যে ২ জন টেইলারিং, ৬ জন খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরন, ৬ জন মোবাইল সার্ভিসিং এবং ৭ জন বিউটিফিকেশন। রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন এলকায় ৯ আদিবাসী জন নারী ও কিশোরী শহর সমাজসেবা অফিস হতে প্রশিক্ষণ গ্রহন করেছে যার মধ্যে ৬ জন ব্লক বাটিক এবং ৩ জন কম্পিউটার বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহন করছে।
এছাড়া মোট ১৬ জন আদিবাসী নারী ও কিশোরী সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সাথে যোগাযোগ করে করোনা মহামারীতে সরকারী জিআর প্রকল্পের সহায়তা বাবদ প্রত্যেকে ৪৫০-৫০০ টাকা করে মোট ৭৪৫০ টাকা ও ১০ কেজি চাল গ্রহন করেছে। কর্ম এলাকায় নারীদের পাশাপাশি কিশোরী গ্রুপও দায়িত্বের সাথে কাজ করে চলেছে। কিশোরীরা বিভিন্ন তথ্য দিয়ে সহায়তা করে এবং তারা নিজেরা উপজেলা প্রশাসনের সাথে যোগাযোগ করে মোট ২০ জন ’ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্টির শিক্ষার্থীদের বিশেষ শিক্ষা সহায়তা’ বাবদ ৬১, ৭০০ টাকা ও শিক্ষা উপকরণ সহায়তা পেয়েছে। যার মধ্যে ৭ জন ৬০০০ টাকা করে ৭ জন ২৪০০ টাকা করে এবং ৪ জন শিক্ষা উপকরণ পেয়েছে।
তথ্য অধিকার আইন ব্যবহার করে আদিবাসী নারীরা গ্রাম উন্নয়ন ও রাস্তা মেরামতে অবদান রাখছেন। গোগ্রাম ইউনিয়নের মুরারীপুর গ্রামে পাঁকা রাস্তা হতে গ্রামের ভেতর প্রায় ২০০ মিটার কাচা রাস্তা দিয়ে যেতে হয় এবং বর্ষার সময় এই রাস্তা ব্যবহারের অনুপযুক্ত হয়ে পড়ে। রাস্তা দিয়ে ট্রাকট্রর যাওয়ার ফলে রাস্তার দুই পাশে ২/৩ ফিট গর্তও সৃষ্টি হয় এবং পানি জমে থাকে। এই গর্তে পড়ে অনেক বৃদ্ধ এবং শিশু আহত হয়েছে। বর্ষাকালে কোন মানুষ অসুস্থ হলে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া সমস্যা হয়ে পড়ে। এলাকার নারীরা তাদের গ্রুপের মাসিক মিটিংয়ে বিষয়টি নিয় আলোচনা করে তাদের ভাংগা রাস্তা মেরামত করার জন্য দলবদ্ধভাবে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বরাবর আবেদন করেন। তাদের আবেদনের প্রেক্ষিতে গোগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান অতি দ্রুততার সাথে উক্ত রাস্তাটি পাকা করেন।
গোগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বলেন, ’আমি বুঝতে পারিনি কিভাবে আদিবাসী নারী এতদুর অধিকার সচেতন হয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে আদিবাসী নারীরা আর পিছিয়ে থাকবে না তারা এগিয়ে যাবেই। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট এনজিও ও যারা তাদেরকে সচেতন করছেন তা অত্যন্ত প্রশংসনীয় ’। মুরারীপুর গ্রামের এসিডি সংস্থা কর্তৃক গঠিত নারী সংগঠনের সভানেত্রী বিথীকা রানী বলেন, ’আমরা আমাদের অধিকার সম্পর্কে জানতাম না, এছাড়া তথ্য অধিকার আইন যে আমাদের সুবিধার জন্য হয়েছে সেটাও জানি নাই। এসিডি আমাদেরকে এ বিষয়ে জানিয়েছে, এখন আমরা এই আইন ব্যবহার করে অনেক তথ্য জানতে পাচ্ছি এবং এলাকা ও নিজের উন্নয়নের জন্য কাজ করতে পাচ্ছি’।
ইউকে/এসএম