আল আমীনের দুই হাজার কোটি টাকা পাচার!

বার্তাকক্ষ প্রতিবেদন: দেশের কোথাও অফিস নেই। শুধু অনলাইনে এসপিসি ওয়ার্ল্ড এক্সপ্রেস নামের একটি প্রতিষ্ঠান খুলে বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে ১০ লাখের বেশি গ্রাহক সংগ্রহ করে দুই হাজার কোটি টাকার বেশি হাতিয়ে নিয়ে বিদেশে পাচার করেছেন আল আমীন প্রধান। রাজস্ব খাতে একটি টাকাও সরকারের কোষাগারে জমা দেননি। এই অভিযোগে গতকাল আল আমীন ও তাঁর স্ত্রী শারমিন আকতারের যাবতীয় ব্যাংক হিসাব স্থগিত করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এনবিআরের চেয়ারম্যানের দপ্তরে গোয়েন্দা সংস্থা থেকে পাঠানো প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা যায়।

প্রতিবেদনে বলা হয়ছে, আল আমীন এর আগে ডেসটিনিতে চাকরি করতেন। সেখান থেকে বের হয়ে অনলাইনে নামসর্বস্ব এসপিসি ওয়ার্ল্ড এক্সপ্রেস নামের একটি প্রতিষ্ঠান খোলেন। নিজেকে এই প্রতিষ্ঠানের সিইও হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন। গোয়েন্দা শাখা থেকে আল আমীনের নামে বিটকয়েনের বিপরীতে ২০০ কোটি টাকা পাচারেরও অভিযোগ আছে। এসপিসি ওয়ার্ল্ড নামের ওয়েব পেজে বিভিন্ন ধরনের প্রলোভন দেখিয়ে গ্রাহক সংগ্রহ করা হতো। চারটি মডেলে তিনি প্রতারণা করছেন।

জুতা, ব্র্যান্ডের পোশাক, এসি, টিভি, কম্পিউটার, মোবাইল ফোনসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য অর্ধেক দামে দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে আল আমীন মূলত গ্রাহক সংগ্রহ করেছেন। প্রলোভনে আকৃষ্ট হয়ে অনেকে পণ্য কেনার জন্য অগ্রিম টাকা জমা দিয়েছে। এ প্রতিষ্ঠানের শর্ত থাকে, পণ্য পেতে ৩০ দিন আগে মূল্য জমা দিতে হবে। অর্ধেক দামে পণ্য পাওয়ার আশ্বাসে গত বছরের জুলাই থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত প্রায় ১০ লাখ ক্রেতা অর্থ জমা দিয়েছে। এদের মধ্যে মাত্র দুই হাজার ক্রেতাকে পণ্য সরবরাহ করে বাকি গ্রাহকদের অর্থ আল আমীন আত্মসাৎ করেছেন বলে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

এ ছাড়া ‘বোনাস মডেলের’ মাধ্যমেও গ্রাহকদের ঠকিয়ে অর্থ আত্মসাৎ করেছেন তিনি। এই অফারে এসপিসি ওয়ার্ল্ডের ওয়েব পেজে গিয়ে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে এক হাজার বা ৮০০ টাকা পাঠিয়ে গ্রাহক হতে হয়। এরপর বিভিন্ন অপশনে গিয়ে ক্লিক করলে ২০ টাকা বা ২৫ টাকা বা এর চেয়েও বেশি বোনাস গ্রাহকের ব্যাংক হিসাবে বা মোবাইল ব্যাংকিংয়ে জমা হতে থাকে। কিন্তু গ্রাহকদের বোনাস হিসেবে সর্বোচ্চ ১০০ বা ২০০ টাকা দিয়ে বোনাস প্রদান বন্ধ করে দেওয়া হয়। এভাবে বহু মানুষকে গ্রাহক বানিয়ে মাত্র দু-একবার বোনাস দিয়ে বাকি টাকা আল আমীন নিজের পকেটে ভরেন। এই প্রতারণার মাধ্যমে আয় করেছেন হাজার কোটি টাকা।

বহু গ্রাহক বানাতে আল আমীনের আরেকটি পদ্ধতি হলো—একজনের কাছ থেকে এক হাজার ২০০ টাকা নিয়ে গ্রাহক বানিয়ে তাকে আরো চারজনকে গ্রাহক করতে বলা হতো। পরের চারজনের প্রতিজনের কাছ থেকে পাওয়া এক হাজার ২০০ টাকার মধ্যে ৪০০ টাকা প্রথম গ্রাহককে দেওয়া হতো, বাকি ৮শ টাকা আল আমীনের পকেটে যেত। এভাবে মোটা অঙ্কের অর্থ তিনি হাতিয়ে নিয়েছেন। তিনি প্রতিষ্ঠানের প্রচারণায় দেশের জনপ্রিয় ব্যক্তিদের ব্যবহার করেছেন। এসব ব্যক্তি পরে তাঁর জালিয়াতির বিষয়ে জানতে পেরে সরে গিয়েছেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

গতকাল এনবিআর থেকে হিসাব জব্দ করতে নির্দেশ দিয়ে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়, ‘সরকারি রাজস্ব স্বার্থ সংরক্ষণের স্বার্থে আয়কর অধ্যাদেশ ১৯৮৪-এর ১১৬ এ ধারায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে ব্যাংকে পরিচালিত সব হিসাব থেকে অর্থ উত্তোলন ও স্থানান্তর স্থগিত করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ করা হলো।’ চিঠি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এ নির্দেশনা কার্যকর করতে বলা হয় ব্যাংকগুলোকে। একই সঙ্গে হিসাবগুলোর সর্বশেষ স্থিতি জরুরি ভিত্তিতে পাঠাতে বলা হয়েছে।

এর আগে গত সোমবার আল আমীন প্রধান ও তাঁর স্ত্রীর ব্যাংক হিসাব তলব করে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে চিঠি দেয় এনবিআর। চিঠিতে আল আমীন ও তাঁর স্ত্রীর সঞ্চয় হিসাব, চলতি হিসাব, ঋণ হিসাব ও বিদেশি মুদ্রার হিসাব, ক্রেডিট কার্ড, ভল্ট, সঞ্চয়পত্র, ডিপোজিট স্কিম ও বিও (বেনিফিশিয়ারি ওনার্স) অ্যাকাউন্টসহ সব ধরনের হিসাবের তথ্য চাওয়া হয়। বিভিন্ন ব্যাংক থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, আল আমীন ও তাঁর স্ত্রীর ব্যাংক হিসাবে বড় ধরনের লেনদেন হয়েছে এবং ওই অর্থ গ্রাহকদের কাছ থেকে প্রতারণা করে পাওয়া।

প্রসঙ্গত, বিভিন্ন ধরনের মুনাফার আশ্বাস দিয়ে গ্রাহকদের কাছ থেকে কোটি কোটি আদায় করে বিদেশে পাচার করেছে এসপিসি ওয়ার্ল্ডের মতো আরো ওয়েব পেজ ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান। গত ছয় মাস এনবিআরের গোয়েন্দা শাখা সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেলসহ (সিআইসি) বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা যৌথভাবে নজরদারি করে এমন ৫৪ প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত করেছে। এর একটি আল আমীনের প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠান ৬০ লাখের বেশি গ্রাহকের কাছ থেকে ১৭ হাজার কোটি টাকারও বেশি হাতিয়ে নিয়ে বিদেশে পাচার করেছে। বয়সে তরুণরা এসব প্রতারণায় বেশি জড়িত। এদের অনেকে ডেসটিনির মতো প্রতিষ্ঠানে আগে কাজ করেছে।

ইউকে/এএস