ভূমধ্যসাগরেই বিলীন পাঁচ পরিবারের স্বপ্ন!

মাদারীপুর সংবাদদাতা: মাদারীপুর জেলার রাজৈর উপজেলা ও পার্শ্ববর্তী এলাকার ৫ তরুণ তাদের তারুণ্য আর দালালের দেখানো রঙিন স্বপ্ন বুনতে থাকেন নিজের ভেতরে। অন্যান্যদের মতোই ঝুঁকি নিতে দ্বিধা নেই তাদেরও।

ইতালি পৌঁছাতে পারলেই ভবিষ্যত জীবন কাটবে সুখে-শান্তিতে। পরিবারের আর্থিক অনটন দূর হবে চিরকালের জন্য। এমন স্বপ্ন দেখেই ইতালি যাওয়ার স্বপ্ন নিয়ে বাড়ি ছাড়েন তারা।

তবে দালালদের দেখানো রঙিন স্বপ্ন আর প্রলোভনের মোহ কাটে লিবিয়া যাওয়ার পরেই। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়েই যেতে হবে ইতালি। ওই মুহূর্তে আর ফিরে আসার সুযোগ নেই তাদের। জীবন-মরণ সঁপে দিয়ে প্রস্তুতি নিতে হয় সাগর পারি দেওয়ার। অবশেষে সাগরেই মৃত্যুকে বরণ করে নিতে হয় মাদারীপুরের এই পাঁচ তরুণের।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, অবৈধভাবে সমুদ্রপথে ইতালি যাওয়ার পথে লিবিয়ার ভূমধ্যসাগরে তীব্র গরম আর পানির সংকটে হিটস্ট্রোকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে মাদারীপুর জেলার রাজৈর উপজেলার চারজন এবং পার্শ্ববর্তী গোলাপগঞ্জ জেলার মুকসুদপুর উপজেলার একজন। গত ১৯ জুলাই লিবিয়া থেকে ইতালি যাওয়ার পথে ভূমধ্যসাগরে তাদের মৃত্যু হয়। ওই নৌকায় থাকা অপর যুবক সুস্থ হওয়ার পর বাড়িতে এই মৃত্যুর সংবাদ দিলে বিষয়টি জানাজানি হয়। রোববার (২৫ জুলাই) রাতে নিহতের পরিবারের কাছে ওই বোটে একইসঙ্গে থাকা বেঁচে যাওয়া যুবক মো. হৃদয় এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

মৃতরা হলেন- মাদারীপুর জেলার রাজৈর উপজেলার টেকেরহাট ঘোসালকান্দি গ্রামের মোশারফ কাজীর ছেলে হৃদয় কাজী (২২), শংকরদী গ্রামের আজিজুল শিকদারের ছেলে সাগর শিকদার (২৩), হোসেনপুর গ্রামের আজিজ শেখের ছেলে জিন্নাত শেখ (২৫), উল্লাবাড়ি গ্রামের বিজেন্দ্রনাথ মল্লিকের ছেলে সাধন মল্লিক (২৪) এবং পার্শ্ববর্তী গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার তপারকান্দি গ্রামের ফজলু মুন্সীর ছেলে সজিব মুন্সী (২০)।

নিহতের স্বজনরা জানান, প্রায় তিন মাস আগে রাজৈর এলাকার অনেক যুবকই দালাল চক্রের খপ্পরে পড়ে লিবিয়াতে আটকা পড়ে। এদেশ থেকে সহজেই ইতালি পৌঁছে দেওয়ার কথা বলে তাদের লিবিয়াতে আটকে রাখে। পরে গত ১৯ জুলাই তাদের ভয়ভীতি দেখিয়ে বাধ্য করে লিবিয়া থেকে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় করে ভূমধ্যসাগরে পারি দেওয়ার। উদ্দেশ্য সাগর পথে ইতালি পৌঁছে দেবে তাদের। অভিবাসন প্রত্যাশীদের নৌকাটির ইঞ্জিন ভূমধ্যসাগরে থাকা অবস্থাতেই বিকল হয়ে যায়। ইঞ্জিন নষ্ট থাকা অবস্থাতেই তাদের নিয়ে নৌকাটি সাগরে চারদিন ধরে ভাসতে থাকে। প্রচণ্ড গরম আর রোদে বোটেই প্রাণ হারায় পাঁচ যুবক।

একই নৌকা থাকা রাজৈর উপজেলার ঘোষালকান্দি গ্রামের ওয়াদুদ মিয়ার ছেলে মো. হৃদয়সহ আরো পাঁচ/ছয়জন অসুস্থ হলেও মো. হৃদয় ভাগ্যক্রমে বেঁচে যায়। পরে সাগরে ভাসতে থাকা অবস্থায় নৌপুলিশ ও কোস্টগার্ড জীবিতদের উদ্ধার করে তিউনেশিয়ার হাসপাতালে ভর্তি করে। তারা সুস্থ হলে মো. হৃদয় গত রোববার (২৫ জুলাই) রাতে ফোন করে এ ঘটনা খুলে বলেন।

হৃদয়ের বরাত দিয়ে নিহতের স্বজনরা জানান, ঘটনার দিন সম্ভবত ২৩ জুলাই সাগরে ভাসতে থাকা অবস্থায় হৃদয় কাজী পানির জন্য হাহাকার করতে থাকে। তখন ট্রলারে কোনো পানি ছিল না। ও পানি পানি করতে করতে আমার কোলেই মারা যায়। ওই সময় সাগর শিকদার, জিন্নাত শেখ, সজীব মুন্সী আর সাধন মল্লিকের কোনো খোঁজ আমার কাছে ছিল না। আমরা যারা অসুস্থ ছিলাম। পরে তিউনেশিয়ার হাসপাতালে চিকিৎসার পর সুস্থ হয়ে উঠলে খোঁজ-খবর নিয়ে ওদের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত হই।

নিহত জিন্নাত শেখের মা হালিমা বেগম কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘রাজৈর উপজেলার সত্যাবর্তী গ্রামের দালাল রেজাউল শেখ ও শহিদুল মোল্লা আমার ছেলেকে ইতালী পৌঁছে দেবে বলে কয়েক দফায় ১১ লাখ টাকা নিয়েছে। অথচ আমার ছেলেকে সাগরে ঠেলে দিয়ে মেরে ফেললো।

তপারকান্দি গ্রামের মৃত সজিব মুন্সীর মা শাহানা বেগম বলেন, আমার ছেলের সঙ্গে সর্বশেষ গত ১৮ জুলাই ফোনে কথা হয়েছে। তখন আমার ছেলে আমাকে বলছিল, ‘মা আমার জন্য দোয়া করো আমাকে এখন দালাল ‘গেম ঘরে’ নিবে। এরপর আর কথা হয়নি। কয়েক দফায় সত্যবর্তী গ্রামের দালাল শাহিন সরদার আমাদের কাছ থেকে টাকা নিয়েছে। ’

এলাকাবাসী জানায়, গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার বড়দিয়া গ্রামের মানব পাচারচক্রের সদস্য ইলিয়াছ ফকির, টুটুল ফকির এবং রাজৈর উপজেলার সত্যবর্তী গ্রামের শাহিন সরদার, রেজাউল শেখ, শহিদুল মোল্লা, ইলিয়াছ শেখ ও শ্রীরামপুরের লিটন মোল্লা ইতালি নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখিয়ে একেকটি পরিবারের কাছ থেকে ৭ থেকে ১১ লাখ টাকা আদায় করে বিভিন্ন সময়ে। এই সব পরিবার জমি বিক্রি করে, ধার-দেনা করে তাদের চাহিদা মতো টাকা পরিশোধ করেন। অথচ মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে এই যুবকদের লিবিয়া থেকে সাগরে করে ইতালি পাঠায়। মূলত এই সব দালালচক্র ইচ্ছে করেই কাজটি করে। মোটা অংকের টাকা আত্মসাৎ করে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয় যুবকদের। ভাগ্যক্রমে কেউ কেউ বেঁচে গেলেও মৃত্যুর কোলে ঢলে পরে অনেকেই।

রাজৈর থানার ওসি (তদন্ত) আনোয়ার হোসেন বলেন, ভূমধ্যসাগরে রাজৈর এলাকার চার যুবকসহ পাঁচজনের মৃত্যুর খবর পেয়েছি। খুবই মর্মান্তিক ঘটনা। নিহত যুবকদের পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ইউকে/এএস