নিজস্ব প্রতিবেদক: পাখির মতোই মনের সুখে শুধু গানই করেন। কারও কাছে তিনি মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, কারও কাছে তিনি মান্না দে। মানুষকে সুরে ভাসাতে পারতেন, সুরের মূর্ছনায় ভুলিয়ে দিতে পারতেন দুঃখ-বেদনা। তবে, পেশায় তিনি ছিলেন ভ্যানচালক। করতেন কৃষিকাজও। সুরের সন্ধান যেখানেই পেয়েছেন, ছুটে গেছেন। গলায় তুলে নিয়েছেন।
কিন্তু এখন আর গান শুনিয়ে মানুষকে মুগ্ধ করবেন না রেজাউল। থেমে গেছে তার কণ্ঠ। গুণী কণ্ঠশিল্পী রেজাউল করিমের ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে।
শনিবার (১৪ আগস্ট) বিকেলে নাটোরের লালপুর উপজেলার আড়বাব ইউনিয়নের ঢুষপাড়া কৃষ্ণরামপুর গ্রামের একটি গাছে ঝুলন্ত অবস্থায় তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
নিহত রেজাউল করিমের (৫৪) বাড়ি রাজশাহীর বাঘা উপজেলার দিঘা গ্রামে। তার স্ত্রী, দুই মেয়ে ও এক ছেলে আছে। তিনি বাংলাদেশ বেতার রাজশাহীর তালিকাভুক্ত শিল্পী ছিলেন। রেজাউল করিম নজরুল ও রবীন্দ্রসংগীতও গাইতেন।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গত শুক্রবার (১২ আগস্ট) নাটোরের লালপুর উপজেলার কৃষ্ণরামপুর গ্রামের নিখিল সরকারের মেয়ে চৈতালি রানি সরকারের বিয়েতে বাদ্যযন্ত্র ক্যাসিও বাজানোর জন্য যান রেজাউল করিম।
শনিবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে শরীর খারাপ লাগার কথা বলে ঘুমাতে যান। বেশ কিছু সময় পার হয়ে গেলে তিনি ফিরে না আসায় সবাই খোঁজাখুঁজি শুরু হয়। পরে বিকেলে বাড়ির পেছনের আম বাগানে গাছের ডালের ঝুলন্ত অবস্থায় তার মরদেহ দেখতে পাওয়া যায়। কাঁচা পাটের দড়িতে ঝোলানো মরদেহ দেখতে পেয়ে স্থানীয় লোকজন পুলিশে খবর দেয়।
কনের চাচাতো ভাই মিঠুন কুমার সরকার বলেন, শনিবার সকাল থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত বাদ্যযন্ত্রের দল বাদ্য বাজিয়েছেন রেজাউল করিম। তারপর থেকে রেজাউল করিমকে দেখা যাচ্ছিলো না। বিকেলে কনে বিদায়ের সময়ও বাজনা বাজানোর জন্য তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিলো না। এরই মধ্যে এক ব্যক্তি বাড়ির পেছনে গিয়ে আমগাছে পাটের কাঁচা আশ দিয়ে গলায় ফাঁস লাগানো অবস্থায় রেজাউল করিমকে ঝুলতে দেখেন। এরপর পুলিশে খবর দেওয়া হয়।
জানতে চাইলে লালপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফজলুর রহমান বলেন, মরদেহ দেখে প্রাথমিকভাবে আত্মহত্যা বলে মনে হচ্ছে। তবে, সেটি নিশ্চিত করে বলা যাবে না। ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন পাওয়া গেলেই মৃত্যুর কারণ নিশ্চিত করে বলা যাবে। এখন আমরা ঘটনাটি তদন্ত করছি।
এদিকে, রেজাউল করিমকে হত্যা করে মরদেহ ঝুলিয়ে দেওয়ার অভিযোগ করেছেন তার ছোট ভাই লিলন উদ্দিন। তিনি বলেন, খবর পেয়ে আমি ঘটনাস্থলে ছুটে যাই। আমার ভাই গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করতে পারেন না। তাকে হত্যা করে মরদেহ ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে।
পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, রেজাউল করিম ১৩ বছর বয়সে মাত্র এক বছরের ব্যবধানে বাবা-মাকে হারান। ওই বয়সে ছোট চার ভাই-বোনের অভিভাবক হয়ে ওঠেন তিনি। বাবা আয়েজউদ্দিন ছিলেন যাত্রার অভিনেতা। তার গলায় ছিলো অসাধারণ সুর। মা মমতাজ বেগমের গলাতেও ছিলো সুর। মায়ের কোলে বসে শিশু রেজাউলের বাবার কাছে গানের হাতেখড়ি হয়। সুরের সন্ধান যেখানেই পেয়েছেন, ছুটে গেছেন। গলায় তুলে নিয়েছেন। বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করে যাত্রাপালায় শিশুশিল্পীর অভিনয় শুরু করেন। বড় হয়ে অভিনয় ছেড়ে দিয়ে যাত্রায় যন্ত্রসংগীত বাজিয়েছেন।
যাত্রাপালার দুর্দিন পড়ে গেলে রেজাউল করিম রিকশা চালান। একপর্যায়ে ২০১১ সালের মার্চ মাসের দিকে রাজশাহী থেকে ঢাকায় গিয়ে রিকশা চালাতে শুরু করেন তিনি। রিকশা চালানোর সময় গুন গুন করে গান করেন তিনি। এই গুন গুন শুনে এক যাত্রী একদিন মাছরাঙা টেলিভিশনে নিয়ে যান তাকে। কর্তৃপক্ষ এক ঘণ্টার একটি গানের অনুষ্ঠান সরাসরি সম্প্রচার করে। এর কয়েক মাস পর তিনি রাজশাহীতে ফিরে আসেন।
বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল এটিএন নিউজ গত রোজার ঈদে ‘আনসাং স্টার’ অনুষ্ঠানে তার কয়েকটি গান প্রচার করে। অনুষ্ঠানে তাঁকে ‘স্টার অব দ্য স্টারস’ ঘোষণা করা হয়।
রেজাউল করিম বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশ বেতারের শিল্পী হিসেবে তালিকাভুক্তির জন্য পরীক্ষা দিয়েছেন। সেখান থেকে ফিরিয়ে দেওয়া হয় তাকে।
সম্প্রতি রাজশাহী বেতারে তার জন্য বিশেষ অডিশনের আয়োজন করা হয়। রেজাউলের গান শুনে বিচারকেরা মুগ্ধ হয়ে সঙ্গে সঙ্গে তাকে বেতারের নজরুলসংগীত শিল্পী হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়।
অনেক অভাব অনটনের সঙ্গে সংগ্রাম করে টিকে ছিলেন রেজাউল করিম। সম্প্রতি একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের আওতায় তার স্ত্রী ছাপিয়া বেগমকে একটি গাভী দেওয়া হয়েছে। রেজাউল করিম সেই গাভীর ঘাস কাটেন। দুধ বিক্রি করে প্রতিদিন ১২০ টাকা পান। এটিই সংসারের আয়ের প্রধান উৎস। পাশাপাশি ভ্যান গাড়িও চালাতেন।
রেজাউল করিমের একমাত্র ছেলে সাগর ও মেয়ে রোকসানারও রয়েছে বাবার মতোই গানের গলা। সকালে ঘুম থেকে উঠে সবাই গলা সাধেন। ছেলে সাগর দশম শ্রেণীতে পড়ে। সংসারের অনটনের কারণে মেয়েটিকে নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় বিয়ে দিয়েছিলেন। সেখানেও মেয়ের সুখ হয়নি। সে এখন ঢাকায় তৈরি পোশাক কারখানার কাজ করে।
এমন জাত শিল্পী রেজাউল করিমের হারমোনিয়াম-তবলা কিছুই ছিলো না। প্রতিবেশীর একটি হারমোনিয়াম চেয়ে নিয়ে রেওয়াজ করতেন তিনি৷ তার মৃত্যুতে এলাকাবাসী ও সঙ্গীতপ্রেমীদের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে এসেছে।
ইউকে/এএস