‘লৈঙ্গিক’ জটিলতায় ভ্যাকসিন বঞ্চিত তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ

নিজস্ব প্রতিবেদক: করোনার টিকা নিয়ে রাজশাহীতে মানুষের আগ্রহ ক্রমশই বাড়ছে। তবে রাষ্ট্রীয় ও সরকারিভাবে স্বীকৃত তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর (হিজড়া) অনেকেই করোনা টিকা কার্যক্রমের বাইরেই রয়ে গেছেন।

জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) ও জন্ম নিবন্ধন সনদ না থাকা, সুরক্ষা ওয়েবসাইটে লিঙ্গ পরিচয় না থাকাসহ নানা জটিলতার কারণে টিকা নিতে ভোগান্তিতে পড়ছেন তারা। আর বিধিবদ্ধ সব নিয়ম মেনে ভ্যাকসিন নিতে কেন্দ্রে গেলে সেখানেও পড়তে হচ্ছে নানান বিড়ম্বনায়।

সোমবার (১৬ আগস্ট) সকালে মহানগরীর শিরোইল এলাকায় কথা হয় তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের সঙ্গে। তারা বলছেন, ২৫ বছরের ঊর্ধ্বে রাজশাহীর সব মানুষ করোনার গণটিকা ক্যাম্পেইন ও টিকাদান কর্মসূচির আওতায় আসলেও কেবলমাত্র হিজড়া হওয়ায় সেই সুযোগ তারা পাচ্ছেন না। পরিবার বা সমাজের মূল ধারার সঙ্গে যোগাযোগ না থাকায় অনেকেরই আবার নেই জাতীয় পরিচয়পত্র বা জন্ম নিবন্ধন সনদ! কয়েকজন এবার ভোটার হলেও জাতীয় পরিচয়পত্র পেয়েছেন পুরুষ কিংবা নারী পরিচয়ে। ফলে তারাও নিবন্ধন করেননি টিকা নিতে। আবার নিবন্ধনের জন্য সুরক্ষা ওয়েবসাইটেও রাখা হয়নি তৃতীয় লিঙ্গ পরিচয়ে নিবন্ধনের সুযোগ। যে কারণে অতি প্রয়োজনীয় করোনা ভ্যাকসিন নিতে গিয়েও লৈঙ্গিক জটিলতার আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছেন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ।

হিজড়া জনগোষ্ঠির লোকজন বলছেন- রাজশাহীতে করোনার টিকা নিতে কয়েকটি বাধায় পড়তে হচ্ছে। জন্মনিবন্ধন বা জাতীয় পরিচয়পত্র না থাকা, বয়সসীমা নিয়ে বিভ্রান্তি, সুরক্ষা অ্যাপে তৃতীয় লিঙ্গ অপশন না থাকা, নিবন্ধন প্রক্রিয়া সম্পর্কে ধারণা না থাকা ও টিকাকেন্দ্রে লাইনে দাঁড়াতে ভোগান্তিই এর মধ্যে অন্যতম। মূলত এসব সমস্যাগুলোর কারণে তারা করোনা টিকা নিতে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। এ অবস্থায় তাদের অনেকেই আক্রান্ত হচ্ছেন- মরণঘাতী এই ভাইরাসে।

তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর সদস্য মিতু বলেন, নিবন্ধন করে এনআইডি কার্ড নিয়ে টিকাকেন্দ্রে যাওয়ার পর আমাদের ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে। টিকার জন্য ছেলেদের লাইনে দাঁড়ালে বলে মেয়েদের লাইনে যেতে। কিন্তু আবার মেয়েদের লাইনে দাঁড়ালে ছেলেদের লাইনে পাঠিয়ে দেয়। কার্ড থাকার পরও আমরা টিকা নিতে পারছিনা। আমরাও তো এই দেশেরই নাগরিক। হিজড়া বলে আমি কি ভ্যাকসিন নিতে পারবো না?

আরেক সদস্য মোখলেস বলেন, টিকা নিবন্ধনের অ্যাপে পুরুষ ও নারীর ঘর আছে। কিন্তু হিজড়াদের জন্য নির্দিষ্ট কোনো ঘর নেই। স্বীকৃতিই যদি না থাকে, তাহলে আমরা কীভাবে করোনার টিকা নেব? গণটিকা ক্যাম্পেইন চলাকালে তিনদিন গিয়েছিলাম। কিন্তু ২ নম্বর ওয়ার্ডের মোল্লাপাড়া কেন্দ্র থেকে তিনদিনই ফিরিয়ে দিয়েছে। এখন বলছে- রেজিস্ট্রেশন করে আসতে হবে। কিন্তু কীভাবে করবো আমাদের জন্যও তো সুরক্ষা অ্যাপসে কোনো ঘর-ই নেই!

এদিকে, রাজশাহীতে দীর্ঘদিন থেকে তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে কাজ করছে ‘দিনের আলো হিজড়া সংঘ’। এর কোষাধ্যক্ষ মিস জুলি বলেন, টিকার জন্য কেন্দ্রে গিয়ে লাইনে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে তৃতীয় লিঙ্গের অনেকেই সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। নারীরা আমাদের বলেন পুরুষদের লাইনে যেতে, আবার পুরুষেরা বলেন নারীদের লাইনে যেতে। আমাদের জন্য আলাদা লাইনের ব্যবস্থা থাকলে এমন সমস্যা হতো না। আবার সুরক্ষা ওয়েবসাইটেও তৃতীয় লিঙ্গের জন্য আলাদা পরিচয় নেই। তাই রেজিস্ট্রেশন নিয়েও সমস্যা হচ্ছে। এসব বিষয়গুলো সরকারের ভেবে দেখা উচিত।

আর টিকাদান কর্মসূচিতে তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর সুরক্ষার বিষয়গুলো ভাবা হয়নি বলে মনে করেন- দিনের আলো হিজড়া সংঘের সাধারণ সম্পাদক সাগরিকা খান। তিনি বলেন, টিকা নেওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের সমস্যাগুলোর দ্রুত সমাধান হওয়া উচিত। বেঁচে থাকার তাগিদে আমাদের দোকানে দোকানে গিয়ে অর্থ সংগ্রহ করতে হয়। আমরা যদি করোনা আক্রান্ত হয় তাহলে যাদের সংস্পর্শে আসবো তারাও আক্রান্ত হবে। কিন্তু টিকাদান কর্মসূচিতে সুরক্ষার বিষয়গুলো ভাবা হয়নি। তাই অনেকটা বাধ্য হয়েই তাকে পুরুষ পরিচয়ে টিকা নিতে হয়েছে বলেও জানান সাগরিকা।

এই প্রতিষ্ঠান সভাপতি ও তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর মোহনা মঈন বলেন, সরকার দেশের সকল নাগরিককে টিকা দিচ্ছে। দেশের নাগরিক হিসেবে ভ্যাকসিন পাওয়া আমার অধিকার। নিবন্ধন প্রক্রিয়ার বিষয়ে স্থানীয়ভাবে বেশিরভাগ জনপ্রতিনিধি বা প্রশাসন আমাদের সহায়তা করেন নি। কেবল মহানগরীর ১৮ ও ১৯ নম্বরসহ হাতেগোনা কয়েকটি ওয়ার্ডে সহযোগিতা করছে।

এনআইডি না থাকায় বেশিরভাগ কেন্দ্র থেকেই ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। রাজশাহী জেলা ও মহানগর মিলিয়ে হিজড়া জনগোষ্ঠীর মানুষের সংখ্যা প্রায় ৯০০ জন। কিন্তু এখন পর্যন্ত টিকা পেয়েছেন ১০০ জনেরও কম।

তিনি আরও বলেন, সামাজিকভাবে গ্রহণ না করার কারণে মানবিক ও মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়ায় টিকা নেওয়ার সুযোগ থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন তারা। এসব সমস্যার কারণে অনেকেই টিকা নিতে অনাগ্রহী। এজন্য তাদের টিকাদানের বিশেষ ব্যবস্থা নিতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন জানান এই নেত্রী।

সার্বিক বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে রাজশাহী সিভিল সার্জন ডা কাইয়ুম তালুকদার বলেন, সুরক্ষা অ্যাপসে তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত বিষয়টি এরই মধ্যে নজরে এসেছে। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হবে। তবে টিকা কেন্দ্র থেকে হিজড়া জনগোষ্ঠীর মানুষেকে বাইরে বের করে দেওয়া বা লাইনে দাঁড়াতে না দেওয়া বা তাদের জন্য পৃথক লাইনের ব্যবস্থার বিষয়টি সিটি করপোরেশন ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদেরই দেখতে হবে। এ ব্যাপারে সরকারি কোনো নির্দেশনা নেই। এটি সামাজিকভাবেই মোকাবিলা করতে হবে বলেও উল্লেখ করেন- রাজশাহী জেলা সিভিল সার্জন।

একই কথা জানান- টিকা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান রাজশাহী সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. এফএএম আঞ্জুমান আরা বেগম। তিনি বলেন, বিষয়টি নিয়ে এরই মধ্যে তারা কাজ শুরু হয়েছে। এই সমস্যাটি কেবল রাজশাহীর নয়, সারাদেশেরই। আর লাইনে দাঁড়ালে যেন হিজড়া জনগোষ্ঠীর সদস্যদের বের করে না দেওয়া হয় সেই ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলবেন বলেও জানান এই প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা।

ইউকে/এএস