ড. হারুন অর রশিদ |
এক মহীয়সী নারী বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব, আমাদের বঙ্গমাতা। তিনি শুধু বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণীই ছিলেন না, তিনি ছিলেন তাঁর রাজনৈতিক জীবনসঙ্গীও।
রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণে পালন করেছেন দিশারীর ভূমিকা। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী গ্রন্থ (ইউপিএল ২০১২)-এ বহু রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও বিশিষ্টজন সম্বন্ধে আলোকপাত করা হয়েছে। যে ক’জন তাঁর জীবনকে গভীরভাবে প্রভাবান্বিত করেছেন তাঁদের মধ্যে বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবের নাম অগ্রগণ্য। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র পাতায় যেভাবে বিষয়টি ফুটে ওঠেছে, এ লেখায় তার অংশ বিশেষ তুলে ধরা হয়েছে।
বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবের পারিবারিক নাম রেণু। বঙ্গবন্ধুর বাল্যকালে বাবা-মা হারানো চাচাতো বোন রেণু-এর (বয়স মাত্র ৩ বছর) সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার তেমন সুযোগ না হলেও, তিনি ছিলেন একজন জ্ঞানী, বুদ্ধিদীপ্ত, বিচক্ষণ, দায়িত্ববান ও ধৈর্যশীল নারী। বঙ্গবন্ধুর জীবনে তাঁর প্রভাব ছিল অপরিসীম। এত দিন বিভিন্ন সূত্র থেকে তা জানা গেলেও, এখন বঙ্গবন্ধুর নিজের কথা থেকে বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব সম্বন্ধে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও অজানা তথ্য জানা যায়। বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী লেখার পেছনেও মূল প্রেরণা ও উৎসাহ তাঁরই। এ সম্বন্ধে বঙ্গবন্ধু বলেন:
আমার সহধর্মিণী একদিন জেলগেটে বসে বলল, “বসেই তো আছ, লেখ তোমার জীবনের কাহিনী। ” বললাম, “লিখতে যে পারি না; আর এমন কি করেছি যা লেখা যায়!” “…আমার জীবনের ঘটনাগুলি জেনে জনসাধারণের কি কোনো কাজে লাগবে? কিছুই তো করতে পারলাম না … আমার স্ত্রী যার ডাক নাম রেণু- আমাকে কয়েকটা খাতাও কিনে জেলগেটে জমা দিয়ে গিয়েছিল। জেল কর্তৃপক্ষ যথারীতি পরীক্ষা করে খাতা কয়টা আমাকে দিয়েছেন। রেণু আরও একদিন জেলগেটে বসে আমাকে অনুরোধ করেছিল। তাই আজ লিখতে শুরু করলাম। ” (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ. ১)
বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন সময় কারাগারে বন্দি থাকাকালে বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবের পার্টির কর্মীদের খোঁজখবর নেওয়া, দলীয় কর্মকা- পরিচালনার জন্য সংসারের খরচের টাকা থেকে সঞ্চয় করে তা কর্মীদের দেওয়া, আগরতলা মামলায় (১৯৬৮-৬৯) বিচারাধীন থাকাকালীন নিঃশর্ত মুক্তি ছাড়া প্যারোলে মুক্তিতে সম্মতি জ্ঞাপন না করার ব্যাপারে বঙ্গবন্ধুর নিকট খবর পাঠানো- বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবের এসব ভূমিকা সম্বন্ধে জনশ্রুতি ও কিছু লেখালেখি রয়েছে। আলোচ্য গ্রন্থটি পাঠ থেকে বুঝা যায়, এর সবই ছিল সত্যি।
অসমাপ্ত আত্মজীবনী-তে প্রসঙ্গক্রমে বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবের ভূমিকা বর্ণনা করতে গিয়ে নানা ঘটনা তুলে ধরেছেন বঙ্গবন্ধু (পৃ. ৭২, ১২৬, ১৪৬, ১৬৪, ১৬৫, ১৯১, ২০৫, ২০৭, ২১০, ২১১, ২৬২, ২৭০, ২৭১, ২৮৫)। এসবের মধ্যে বঙ্গবন্ধুকে চলার জন্য টাকা জোগাড় করে গোপনে তা তাঁকে দেওয়া, সম্মেলনের অতিথিদের খাবারের বন্দোবস্ত করার জন্য টুঙ্গিপাড়া থেকে গোপালগঞ্জ আসা, বঙ্গবন্ধুর বিএ পরীক্ষার সময় উৎসাহ যোগান ও যত্ন নিতে কলকাতা ছুটে আসা, ঢাকায় অতি কষ্টে বাড়ি ভাড়া করে থাকা, বঙ্গবন্ধু বন্দি থাকা অবস্থায় ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া চালানোসহ সংসারের হাল ধরা, বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তার হওয়ার পূর্বে তাঁর প্রয়োজনীয় কাপড়চোপড় ও অন্য জিনিসপত্র স্যুটকেসে প্রস্তুত করে দেওয়া ইত্যাদি রয়েছে। বঙ্গবন্ধু তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, “রেণু খুব কষ্ট করত, কিন্তু কিছুই বলত না। নিজে কষ্ট করে আমার জন্য টাকাপয়সা জোগাড় করে রাখত যাতে আমার কষ্ট না হয়”(পৃ. ১২৬)। আর এক জায়গায় লিখেছেন, “সে [রেণু] তো নীরবে সকল কষ্ট সহ্য করে, কিন্তু কিছু বলে না। কিছু বলে না বা বলতে চায় না, সেই জন্য আমার আরও বেশি ব্যথা লাগে” (পৃ. ১৪৬)।
একবার একনাগারে ১৭-১৮ মাস বঙ্গবন্ধু জেলে কাটান। এক জেল থেকে অন্য জেলে। মামলায় হাজিরা দিতে বঙ্গবন্ধুর গোপালগঞ্জে আসা। জেলের মধ্যে তাঁর স্বাস্থ্য খুবই খারাপ হয়ে পড়ে। অবশেষে জামিনে মুক্তি দেয়া হলেও, পরক্ষণে নিরাপত্তা আইনে পুনরায় গ্রেপ্তার করা হয়। গোপালগঞ্জ থানায় বসে স্ত্রী রেণু বঙ্গবন্ধুকে একাকী পেয়ে যে-কথাগুলো বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধু তা তাঁর আত্মজীবনীতে এভাবে লিপিবদ্ধ করেছেন:
রেণু আমাকে যখন একাকী পেলেন, বললেন, “জেলে থাক আপত্তি নাই, তবে স্বাস্থ্যের দিকে নজর রেখ। তোমাকে দেখে আমার মন খুব খারাপ হয়ে গেছে। তোমার বোঝা উচিত আমার দুনিয়ায় কেউ নাই। ছোটবেলায় বাবা-মা মারা গেছেন … তোমার কিছু হলে বাঁচব কি করে?” … আমি বললাম “খোদা যা করেন, তাই হবে, চিন্তা করে লাভ কি?” (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ. ১৯১)।
১৯৫২ সালের ভাষা-আন্দোলনের সময় ফরিদপুর জেলে বন্দি অবস্থায় (১৫ই ফেব্রুয়ারি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ফরিদপুর কারাগারে স্থানান্তরিত হন) বঙ্গবন্ধু ও মহিউদ্দিন আহমেদ ১৬ই ফেব্রুয়ারি থেকে আমরণ অনশন শুরু করেন। ২৬-২৭ মাস বিনা বিচারে কারাগারে বন্দি। দীর্ঘ কারাভোগের কারণে বঙ্গবন্ধুর শরীর অতিশয় দুর্বল হয়ে পড়ে। হার্টের অবস্থাও খারাপ। বঙ্গবন্ধু ভেবেছিলেন, অনশনেই মৃত্য ঘটবে। তাই তিনি অনশন শুরুর পূর্বে চিরকুটে চারখানা চিঠি লিখেন। এর একখানা ছিল স্ত্রী রেণুর উদ্দেশে। ১২ দিন অনশন করার পর ২৭শে ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেয়া হয়। মুক্তি পেয়ে বাড়ি পৌঁছার পর রেণু বঙ্গবন্ধুর উদ্দেশ্যে যা বলেন, বঙ্গবন্ধু তা এভাবে লিপিবদ্ধ করেন:
তোমার চিঠি পেয়ে আমি বুঝেছিলাম, তুমি কিছু একটা করে ফেলবা। আমি তোমাকে দেখবার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। কাকে বলব নিয়ে যেতে, আব্বাকে বলতে পারি না লজ্জায়। নাসের ভাই বাড়ি নাই। যখন খবর পেলাম খবরের কাগজে, তখন লজ্জা শরম ত্যাগ করে আব্বাকে বললাম … রওয়ানা করলাম ঢাকায়, সোজা আমাদের বড় নৌকায় তিনজন মাল্লা নিয়ে। কেন তুমি অনশন করতে গিয়েছিলে? কিছু একটা হলে কি উপায় হত? আমি এই দুইটা দুধের বাচ্চা নিয়ে করে বাঁচতাম? হাসিনা, কামালের অবস্থা কি হত? তুমি বলবা, খাওয়া-দাওয়ার কষ্ট তো হত না? মানুষ কি শুধু খাওয়া পরা নিয়েই বেঁচে থাকতে চায়? আর মরে গেলে দেশের কাজই বা কিভাবে করতা?” আমি তাকে কিছুই বললাম না। তাকে বলতে দিলাম, কারণ মনের কথা প্রকাশ করতে পারলে ব্যথাটা কিছু কমে যায়। রেণু খুব চাপা, আজ যেন কথার বাঁধ ভেঙ্গে গেছে। শুধু বললাম, “উপায় ছিল না” (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ.২০৭)।
এই কোমলমতি, স্নেহময়ী নারী প্রয়োজনে হয়েছেন কঠিন ও বিচক্ষণ। এরূপ একটি রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণ ছিল ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের বক্তব্য কী হবে, সে সম্বন্ধে এর পূর্বে নানাজন তাঁকে লিখিত-অলিখিত নানা পরামর্শ দিতে থাকেন (সূত্র : শেখ হাসিনা ‘ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণঃ কিছু স্মৃতি’, আবদুল ওয়াহাব (সম্পাদিত), বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণঃ ইতিহাস ও তত্ত্ব, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা ২০১৪, পৃ. ৯১-৯২)। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিও একটানা ৩৬ ঘন্টার এক বৈঠকে মিলিত হয় মর্মে জানা যায়। কিন্তু বৈঠকে কোনো স্থির সিদ্ধান্ত না হওয়ায় উদ্ভূত পরিস্থিতি বিবেচনায় যা বলা আবশ্যক তাই বলবেন বলে বঙ্গবন্ধু নিজের উপর দায়িত্ব তুলে নেন (সূত্র: `Speeches at Dhaka Race Course And GettysburgÓ, Mofizur Rahman in The Financial Express, 31 March 1995, p.9)। এক্ষেত্রে বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব-এর বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য:
… সমগ্র দেশের মানুষ তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। সবার ভাগ্য আজ তোমার ওপর নির্ভর করছে … অনেকে অনেক কথা বলতে বলেছে … তুমি নিজে যে ভাবে যা বলতে চাও নিজের থেকে বলবে। তুমি যা বলবে সেটিই ঠিক হবে।
(সূত্র : শেখ হাসিনা ‘ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণঃ কিছু স্মৃতি’, আবদুল ওয়াহাব (সম্পাদিত), বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণঃ ইতিহাস ও তত্ত্ব, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা ২০১৪, পৃ. ৯১-৯২)।
অতঃপর নির্দিষ্ট সময়ে রেসকোর্সের জনসমুদ্রের সভামঞ্চে এসে উপস্থিত হলেন বঙ্গবন্ধু। পেছনে তাঁর বাঙালির হাজার বছরের মুক্তির আন্দোলন, সংগ্রাম, স্বপ্ন (বিস্তারিত ড. হারুন-অর-রশিদ, বাঙালির জাতীয় মুক্তির সংগ্রাম ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বাংলাদেশ ইতিহাস সম্মিলনী, ঢাকা ২০১৪; ড. হারুন-অর-রশিদ, বাঙালির রাষ্ট্রচিন্তা ও স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়, আগামী প্রকাশনী, ঢাকা ২০০৩, পৃ. ১১-১৬)। বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবের কথা মতো তিনি যেন নিজের কথাটিই বললেন, যা মুক্তির মন্ত্রে উজ্জীবিত সমগ্র বাঙালিরও মনের কথা “… ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে … এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা”।
বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব শুধু বঙ্গবন্ধুর স্ত্রীই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একই সঙ্গে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ রাজনীতি-সচেতন এক মহীয়সী নারী। আমাদের স্বাধীনতা অর্জনে লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকে নিভৃতচারীর বেশে বঙ্গবন্ধুকে তিনি যুগিয়েছেন সর্বপ্রকার সাহস, শক্তি, প্রেরণা। ৭৫-এর ১৫ই আগস্ট ঘাতকের বুলেট শুধু জাতির পিতার জীবনকেই কেড়ে নেয়নি, বিদীর্ণ করে বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবের দেহও। নিষ্পাপ শিশু রাসেলসহ সেদিন প্রাণে রক্ষা পায়নি বঙ্গবন্ধু পরিবারের উপস্থিত কোনো সদস্যই। বঙ্গবন্ধুর জীবনের সুখ-দুঃখের সাথী হয়েই শুধু নয়, মৃত্যুতেও সাথী হয়ে রইলেন তাঁর সহধর্মিণী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব। জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার ৫০ বছর তথা সুবর্ণজয়ন্তীতে তাঁকে আমরা গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতায় স্মরণ করছি।
লেখক: অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সাবেক উপাচার্য, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়
ইউকে/এএস