সোনালি হচ্ছে কৃষকের লালিত ‘স্বপ্ন’

নিজস্ব প্রতিবেদক: কালের বিবর্তনে ‘সোনালি আঁশ’ খ্যাত পাট তার অতীত ঐতিহ্য হারিয়েছে। তবে আবারও নতুন করে স্বপ্ন দেখাতে শুরু করেছে পাট। কৃষকরা পুরোনো ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখার যে লড়াইটা এতদিন ধরে চালিয়ে যাচ্ছেন, তার সুফল আসতে শুরু করেছে।

আশা নিরাশার দোলাচলে সোনালি আঁশে আবারও রঙ্গিন হয়ে উঠেছে কৃষকের আঙ্গিনা। প্রতিবছর এক বুক স্বপ্ন নিয়ে পাটের আবাদ করেন গ্রামের সাধারণ কৃষকরা। রোদ-বৃষ্টিতে ভিজে মাঠে কাজ করেন। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে মাটি থেকে ফসল ফলান। সবুজ পাটকে রূপান্তরিত করেন সোনালি বর্ণে।

এরপরও কষ্টার্জিত ফসল হাটে বিক্রি করতে গিয়ে পড়েন দুর্বিপাকে। কখনো ভালো দাম পান, আবার কখনও একেবারেই পান না। অনেক সময় আবার লাভের চেয়ে ক্ষতিই হয় বেশি। এরপরও সামান্য লাভের আশায় প্রতি বছরই পাটের আবাদ করেন কৃষকরা। তবে পরিস্থিতি পাল্টাতে শুরু করেছে। গেল দুই বছরের ধারাবাহিকতায় পাটের সোনালি অতীত ফেরার সম্ভবনা দেখা দিয়েছে আবারও। বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় পাট চাষ হয়। তবে গুণগত মান বিবেচনায় রাজশাহী অঞ্চলের পাট এখনও শীর্ষে রয়েছে। এ অঞ্চলের পাটপণ্য দেশের গন্ডি পেরিয়ে যাচ্ছে আন্তর্জাতিক বাজারে। চাহিদা ও দাম ভালো থাকায় বরেন্দ্র অঞ্চলে বেড়েছে পাটের চাষ।

বর্তমানে স্থানীয় বাজারে প্রতিমণ পাট বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার ৯০০ টাকা মণ দরে। এমন দামে পাট বিক্রি করতে পেরে লাভের মুখ দেখতে শুরু করেছেন চাষিরা। এদিকে ইউরোপ-আমেরিকাসহ পাটের প্রধান বাজারগুলোতে করোনা ভাইরাস মহামারির প্রকোপ কমে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসতে শুরু করেছে। ফলে রপ্তানিকারকরাও এই খাতটিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছেন এবং গত অর্থবছরের চেয়ে বেশি বিদেশি মুদ্রা আয় করতে নতুন করে তাদের পরিকল্পনা সাজাচ্ছেন।

রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ২০২১-২২ মৌসুমে বিভিন্ন ফসল আবাদের অগ্রগতির প্রতিবেদেন থেকে জানা যায়, চলতি বছর রাজশাহীতে মোট ১৮ হাজার ৩৯ হেক্টর জমিতে পাটের আবাদ হয়েছে। এরমধ্যে শতভাগ পাট কাটা হয়ে গেছে। বৃষ্টি হওয়ায় পুকুর, খাল-বিল ও ডোবা ভরে গেছে। কৃষকরা দারুণ পরিবেশে পাট জাগ দিতে পারছেন।

এবছর মোট পাট উৎপাদন হয়েছে ৪৪ হাজার ৬৪৬ মেট্রিক টন। জমিতে হেক্টর প্রতি ফলন বেশি হয়েছে ২ দশমিক ৮০ শতাংশ। অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় এ বছর ২ দশমকি ৭২ শতাংশ পাট বেশি উৎপাদন হয়েছে। এ বছর পাট চাষ বেড়েছে ৩ হাজার হেক্টর জমিতে।

রাজশাহীর পার্শ্ববর্তী কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা যায়, খাল-বিল, পুকুরসহ ডোবায় পাট কেটে জাগ দেওয়া হয়েছে। গ্রামের রাস্তার পাশে বাঁশের খুঁটি পুঁতে সারি সারি করে শুকাতে দেওয়া হয়েছে পাট। অপরদিকে গুচ্ছ করে বোঝা বেঁধে রাখা হয়েছে পাট খড়ি। পানিতে জাগ দেওয়া পাট ছড়াতেও এখন সারাদিন ব্যস্ত সময় পার করছেন এ অঞ্চলের চাষিরা। পবা উপজেলার নওহাটা পাট আড়ৎ ও জুট মিলস ঘুরে দেখা যায়, পাট কেনাবেচায় ব্যস্ত সময় পার করছেন ব্যবসায়ীরা। জুট মিলগুলোতে ফড়িয়াসহ কৃষকরাও সরসরি পাট বিক্রি করতে আসছেন। গুণ ও মানভেদে প্রতিমণ পাট বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৯০০ টাকা পর্যন্ত।

চাষিদের সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, পাট চাষে খরচ তুলনামূলক কম। পাটের জন্য প্রয়োজন পর্যাপ্ত পানি। এবার আষাঢ়ের শুরু থেকেই তা ছিল পর্যাপ্ত। প্রকৃতি থেকে এবার পাট চাষের প্রয়োজনীয় পানির জোগান মিলেছে। খালে-বিলে পর্যাপ্ত পানি থাকায় পাট জাগ দেওয়ায় কোনো সমস্যা হয়নি। ফলে পাটের গুণগত মান অনেক ভালো হয়েছে। এতে বাজারে দামও ভালো পাচ্ছেন তারা।

পবার মথুরা গ্রামের পাটচাষি নুরুল আমিন বলেন, চলতি বছর তিনি তিন বিঘা জমিতে পাট চাষ করেছিলেন। প্রতি বিঘায় পাট চাষে ১৫ থেকে ১৬ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। পাট হয়েছে সাড়ে ২৫ মণের বেশি। বাজারে পাটের দাম আগের তুলনায় ভালো থাকায় লাভ হয়েছে।

নওহাটা জুট মিলের কর্মচারী ইসমাইল হোসেন বলেন, দীর্ঘ দিন ধরে পাট চাষ করছি। এবারও দুই বিঘায় পাট চাষ করেছিলাম। মোট ১৫ মণ পাট পেয়েছি। এবার পাটের দামও খারাপ নয়। ঈদের পরপরই পাট বিক্রির উপযোগী হয়েছিল। সে সময় পাটের রঙ সুন্দর থাকায় প্রতিমণ পাট ৩ হাজার ৩০০ টাকা দরে বিক্রি করেছি। এখন বাজার দর কমেছে।

রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক (ডিডি) কেজেএম আব্দুল আওয়াল বলেন, আগে পাটের জমিতে আগাছা নিধনের জন্য জমির মালিক বা চাষিকে জমিতে অতিরিক্ত শ্রমিক লাগিয়ে খরচ করতে হতো। বর্তমানে তা আর করতে হয় না। এখন আগাছা নিধনে কীটনাশক বের হয়েছে। উন্নত কীটনাশক থাকায় চাষাবাদে খরচ কমেছে। এখন কম খরচ ও শ্রমে পাট চাষ করা যায় আবার দামও ভালো। তাই রাজশাহীর চাষিরা পাট চাষে আগ্রহী হচ্ছেন। বাজারে ভালো দাম থাকায় লাভবান হচ্ছেন চাষিরা।

তিনি আরও বলেন, রাজশাহীতে পাটের জাগ দেওয়া নিয়ে চাষিরা কিছুটা সমস্যায় পড়েন। অনেকে সঠিক পদ্ধতিতে জাগ দিতে না পারায় সুন্দর রঙ হয় না। এসব সমস্যা দূর করতে কৃষকদের বিভিন্ন পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। আবার পাটের আন্তর্জাতিক বাজারটাকে সম্প্রসারণ করা গেলে তারা আরও বেশি লাভবান হবে। পাটের হারানো গৌরব আবারও ফিরে আসবে।

ইউকে/এএস