নিজস্ব প্রতিবেদক: ষড়ঋতুর এই বাংলায় ভাদ্র-আশ্বিন এ দুই মাস শরৎকাল। তৃতীয় এই ঋতুকে বলা হয় ‘ঋতুরানি’- ও। শীতের আগমনী বার্তা ছড়িয়ে বিদায় নেয় শরৎ। অভিষিক্ত হয় হেমন্তের। কার্তিক আর অগ্রহায়ণ এই দু’মাস মিলে শুরু হয় হেমন্ত। আর হেমন্ত হচ্ছে বাংলার ফসলের মাস। চারদিকে ধান কাটা ও মাড়াইয়ের ধুম পড়ে যায়। নবান্ন উৎসবে মেতে ওঠেন দামাল কৃষক-কৃষাণী। শীতের ফসলে ভরে ওঠে কৃষকের আঙ্গিনা। তবে এবার শরতেই দেখা দিয়েছে হেমন্তের আবহ। শীতকালীন সবজির দাম বেশি থাকায় কৃষকরা তাদের মাঠে আগাম সবজির চাষ করছেন পুরোদমে।
রাজশাহীর গ্রামে গ্রামে শীতকালীন আগাম সবজি চাষের ধুম পড়েছে। অধিক মুনাফার আশায় আশ্বিনের তীব্র তাপকে উপেক্ষা করেই সারাদিন শাক-সবজি পরিচর্যায় দিনের ব্যস্ত সময় পার করছেন চাষিরা। অনুকূল আবহওয়ার কারণে সবজি চাষে কৃষকের আগ্রহও বেড়েছে।
বৃষ্টির কারণে আরও আগে থেকে সবজি চাষ শুরু করতে না পারলেও শেষ দিকে পুরোদমে কাজ করছেন তারা। এরইমধ্যে রাজশাহী জেলার নয় উপজেলার ৭৩১ হেক্টর জমিতে শীতের আগাম সবজির আবাদ করা হয়েছে।
চাষিরা বলছেন, শীতের আগে বাজারে সবজি দিতে পারলে লাভ বেশি হয়। এটিকে লক্ষ্য রেখে মৌসুমের আগে থেকেই সবজি চাষের প্রস্তুতি নেওয়া হয়। এক্ষেত্রে আবাদের বাড়তি পরিচর্যার পাশাপাশি ঝুঁকিও বেশি থাকে। তবে যেহেতু এটা লাভজনক তাই অন্যান্য সময়ের চেয়ে শীতের আগাম সবজি চাষাবাদের পরিমাণও বাড়ছে। সামনে বড় ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে না পড়লে রাজশাহী অঞ্চলে রেকর্ড পরিমাণ শীতের আগাম সবজি উৎপাদন হবে।
রাজশাহী জেলার পবা, দুর্গাপুর, গোদাগাড়ীসহ বিভিন্ন এলাকার মাঠজুড়ে চাষ করা হয়েছে বাঁধাকপি, ফুলকপি, টমেটো, শিম, মুলা, লালশাক-পালংশাক, সবুজ শাকসহ নানা ধরনের সবজি। এরইমধ্যে ১৩০ হেক্টর বেগুন, ২৫ হেক্টর ফুলকপি, ১৩ হেক্টর বাঁধাকপি, ৮০ হেক্টর মুলা, লাউ ৩৫ হেক্টর, শিম ৭২ হেক্টর, বরবটি ৭ হেক্টর, শসা ১ হেক্টর, করলা ৫ হেক্টর, ঢেঁড়স ১০ হেক্টর, মিষ্টিকুমড়া ২১ হেক্টর, ডাটাশাক ১ হেক্টর, লালশাক ৮০ হেক্টর, পালংশাক ১৩ হেক্টর, পুঁইশাক ২ হেক্টর, কলমিশাক ৩ হেক্টরসহ ২৩০ হেক্টর জমিতে টমেটোর আবাদ শুরু হয়েছে।
রাজশাহী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর উপ-পরিচালকের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝিতেই রবি মৌসুমের সবজি আবাদ শুরু হয়ে গেছে। এরই মধ্যে ৭৩১ হেক্টর জমিতে সবজির আবাদ করা হয়েছে। যেটা অক্টোবরের মাঝামাঝিতে গিয়ে লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে। আর রাজশাহীতে গত বছর ১৮ হাজার ১১৪ হেক্টর জমিতে সবজির আবাদ হয়েছিল।
পবা উপজেলার মথুরা গ্রামে গিয়ে দেখা যায় ক্ষেতের পরিচার্যা করছেন চাষি নূরুল আমিন। তিনি বলেন, তারা মৌসুম শুরুর একটু আগেভাগেই বাজারে শীতকালীন সবজি নিয়ে আসতে চান। কারণ এ সময় দাম বেশি থাকে। তাই লাভও বেশি হয়। এজন্য সারাদিন ধরে ক্ষেতের পরিচর্যা করছেন। আশা করছেন দ্রুতই বাজারে শীতের আগাম তরতাজা সব সবজি সরবরাহ করতে পারবেন। তবে শেষ পর্যন্ত বাজার পড়ে যাবে কিনা বা সঠিক দাম পাবেন কিনা সেটি নিয়েও শঙ্কা রয়েছে।
রাজশাহীর দুর্গাপুর গ্রামের চাষি জসিম উদ্দিন বলেন, প্রায় দুই বিঘা জমিতে বাঁধাকপি লাগিয়েছি। শীতের শুরুতে বাজারে নতুন সবজির চাহিদা যেমন বেশি থাকে তেমনি দামও বেশি হয়। তাই শীতের আগাম সবজি বাজারে দিতে দিনভর হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করেছি। প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেন না হয়। আশা করছি বাড়তি লাভের মুখ দেখতে পাব।
এদিকে দীর্ঘ বৃষ্টি ও তুলনামূলক নিচু জমিতে জলাবদ্ধতার কারণে বেশিকিছু কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলেও খবর পাওয়া গেছে। তাদের মধ্যে একজন হলেন- আলিফ হোসেন। তিনি বলেন, শীতকালীন আগাম সবজি বাজারে নিয়ে আসছি চলতি মাসের শুরুতেই। কিন্তু নিচু জমি হওয়ায় তার জমির অর্ধেকের বেশি টমেটো নষ্ট হয়ে যায়। এছাড়া জমিতে বৃষ্টির পানি জমেও অনেকটা ক্ষতি হয়েছে। একই সমস্যায় পড়েছেন আরও কয়েকজন বলে যোগ করেন-তৃণমূলের ওই চাষি।
আগাম শীতকালীন সবজি চাষের বিষয়ে জানতে চাইলে রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কেজেএম আব্দুল আওয়াল বলেন, প্রতি বছরই শীতের শুরুতে মৌসুমি সবজি বাজারে নিতে পারলে দামটা ভালো মেলে। এ সময় সরবরাহ কম থাকায় দাম বেশি হয়। এজন্য সাধারণ ক্রেতারা শীতের আগেই শীতকালীন সবজির স্বাদ নিতে পারেন। আর দাম বেশি হওয়ায় কৃষকরাও বাড়তি মুনাফা পান। ভরা মৌসুমে শীতের সবজির সরবরাহ বেশি থাকায় চাষিরা তুলনামূলক কম লাভবান হয়। আগাম চাষে দাম ভালো থাকায় আগ্রহ নিয়ে কাজ করছেন চাষিরা।
তিনি আরও বলেন, এবার তুলনামূলক বৃষ্টি বেশি হওয়ায় জেলার নিচু জমির চাষিরা কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তবে বড় ধরনের কোনো ক্ষতি হয়নি। আর সবজির চাষ অনেক বেড়েছে। ফলে রাজশাহী অঞ্চলের চাহিদা মিটিয়ে এই সবজি ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তেও সরবরাহ করা সম্ভব হবে।
ইউকে/এএস