প্রলয়ংকরী ভূমিকম্পের শঙ্কায় সিলেট!

বার্তাকক্ষ প্রতিবেদন: একইদিনে পরপর চারবার ভূমিকম্পে কাঁপিয়েছে সিলেটকে। উদ্বেগ-আতঙ্ক ছড়িয়েছে সবখানে। আতঙ্কে ঘর ছেড়ে বেরিয়েছে মানুষ। দফায় দফায় এ ভূ-কম্পণের ঘটনাটি ঘটে শনিবার (২৯ মে)। এরপর ‘বড় ভূইছাল’ আতঙ্ক ছড়িয়েছে সিলেটবাসীর মনে। যদিও ভূমিকম্পের ‘জেঞ্জার জোন’ হিসেবে পরিচিত সিলেটে দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রস্তুতি শূন্যের কোঠায়।

সম্প্রতি সিডিএমপি জরিপ চালিয়ে ঘোষণা করে বড় ভূমিকম্প হলে ৩০ হাজারের বেশি ভবন ধসের আশঙ্কা ব্যক্ত করেছে। পাশাপাশি নতুন নির্মিত দুই শতাধিক ভবন নির্মাণে ফায়ার সার্ভিসের ছাড়পত্র না নেওয়ায় দুর্যোগ ঝুঁকিতে রয়েছে এগুলো। সংশ্লিষ্টরাও স্বীকার করেছেন সিলেট ৭ মাত্রার প্রলয়ঙ্করী ভূমিকম্প হলে যে ধরনের ক্ষয়ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে তা মোকাবিলায় প্রস্তুতি নেই সিলেটে।

জানা গেছে, সাধারণত ১০০ বছর পরপর বড় ধরনের ভূমিকম্প আঘাত হানে ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলে। সর্বশেষ ১৮৯৭ সালে ৮ দশমিক ২ মাত্রার ভূমিকম্পে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল গোটা সিলেট। সেই ঘটনার ১০০ বছর অতিক্রম হওয়ায় আবারও সিলেট অঞ্চলে ভূমিকম্পের শঙ্কা দেখা দিয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ছোট-বড় অনেকগুলো প্লেট টেকটোনিকের ওপর পৃথিবীর অবস্থান। ইন্দো-অস্ট্রেলিয়ান ও ইউরোশিয়ান এই বড় প্লেটে দুটির সংযোগস্থল সিলেটের কাছাকাছি অবস্থিত। এই প্লেট দুটির ঘর্ষণের ফলে প্রায়ই সিলেট অঞ্চলে ভূমিকম্প অনুভূত হয়।

১৮৯৭ সালের ভূমিকম্প সিলেটে ‘বড় ভূইছাল’ নামে পরিচিত। সে সময় মারা যান সিলেটে দেড় লাখেরও বেশি মানুষ। বর্তমানে এই অঞ্চলে হওয়া ঘন ঘন ছোট ভূমিকম্পগুলো বড় ভূমিকম্পের আগাম সংকেত বলেও মন্তব্য করেন বিশেষজ্ঞরা। এ ব্যাপারে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পুর ও পরিবেশ কৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. জহির বিন আলম বলেন, বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল সিলেটের পুরোটাই ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা। যেকোনো সময় বড় ধরনের ভূমিকম্পের আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। গত ১০/১২ বছরে সিলেটে অনেকটা নীতিমালা মেনে ভবন তৈরি হয়েছে। যে কারণে নতুন নির্মিত বহুতল ভবনগুলো কম ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তবে এর আগে নীতিমালা না মেনে গড়ে ওঠা ভবন শঙ্কার কারণ।

তিনি বলেন, একদিনে ৪ বার ভূমিকম্পে বড় ধরনের ভূমিকম্পের ইঙ্গিত করছে। এজন্য আগামী সপ্তাহ ১০ দিন সিলেটের বাসিন্দাদের সতর্ক থাকতে হবে। ইতোমধ্যে দুর্যোগ মোকাবিলায় সব ক’টি ইউনিট নিয়ে প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য সিসিক মেয়রকেও পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে নগরের বাসিন্দাদের লিফট ব্যবহার না করা, বিদ্যুৎ ও গ্যাসলাইন বন্ধ রাখতে হবে। রাতে বিছানার পাশে আলমিরাসহ ক্ষতির কারণ হতে পারে, এমন ভারি আসবাবপত্রগুলো যাতে ঝাঁকুনিতে না পড়ে, সেদিকে নজর দিতে হবে। ভূমিকম্প হলে তাড়াহুড়ো না করে সতর্কতার সঙ্গে নিজেকে টেবিলের বা খাটের নিচে আশ্রয় নিতে হবে। অথবা মাথায় বালিশ দিয়ে নিরাপদ স্থানে বেরিয়ে যেতে হবে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সিলেটে গত এক দশকে গড়ে উঠা দুই শতাধিক ভবনেও ভূমিকম্প মোকাবিলায় নেই যথাযথ ব্যবস্থা। দ্বিতল বা তার চেয়ে বেশি উচ্চতার ভবন নির্মাণের জন্য ফায়ার সার্ভিসের ‘সেফটি প্ল্যান’ ছাড়পত্র গ্রহণ করার বিধান থাকলে ভবন মালিকেরা এ ধরনের কোনো ছাড়পত্র নেননি। দুর্যোগ দেখা দিলে নিরাপদে বের হওয়ার জন্য প্রতিটি ভবনে জরুরি বর্হিগমন রাস্তা, অগ্নি নির্বাপনের জন্য পানি, ড্রাই পাউডার ও ফায়ার ফায়ার এক্সটিংগুইশারের ব্যবস্থা রাখা বাধ্যতামূলক। একইভাবে ৫ হাজার বর্গফুটের বেশি আয়তনের একতলা ভবনের ক্ষেত্রেও ফায়ার সার্ভিসের এ নীতিমালা প্রযোজ্য। কিন্তু এসব ব্যবস্থা না রেখেই সিলেটে একের পর এক গড়ে ওঠছে আকাশচুম্বী বহুতল ভবন।

এ ব্যাপারে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স সিলেট অফিসের সহকারী পরিচালক মো. শহিদুর রহমান জানান, সিলেট ফায়ার সার্ভিসের কাছে নগরীর প্রায় ২শ বহুতল ভবনের তালিকা রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় অর্ধেক ভবন মালিক ফায়ার সার্ভিস থেকে প্রাথমিক অনুমোদন নিলেও চূড়ান্ত ছাড়পত্র নেননি কেউই। ফায়ার সার্ভিসের নীতিমালা না মেনে গড়ে ওঠা ভবনগুলোতে ধস বা অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলে ব্যাপক প্রাণহানির আশঙ্কা রয়েছে।

ছাড়পত্রহীন ভবনগুলোর বিরুদ্ধে শিগগিরই ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে জরিমানা করা হবে। সিলেট সিটি করপোরেশনের ভারপ্রাপ্ত প্রধান প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমান বলেন, দুর্যোগকালীন সময়ে কিছুটা হলেও উদ্ধার তৎপরতা চালাতে ২৫ সদস্যের বিশেষ দল গঠন করে তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে যাচ্ছে ফায়ার সার্ভিস।

ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের সিনিয়র মেট্রোলজিস্ট মুমিনুল ইসলাম বলেন, বিগত বছরগুলোর ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, সিলেটে একদিনে চারবার এমন ভূমিকম্প কখনো হয়নি। এটা সত্যিই ভয়ের কারণ। সিলেট অঞ্চল দীর্ঘদিন ধরেই ভূমিকম্পের ঝুঁকির মধ্যে। বিশেষ করে তিনটি প্লেটের সংযোগস্থলে বাংলাদেশ। মূলত; ডাউকিতে ভূ-গর্ভে বড় ধরনের ফল্ট, সাব ফল্ট লাইন রয়েছে। ফল্ট টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থলকে বোঝায়। এর আশপাশে সাব ফল্ট লাইন থাকে। যা আমপাতার রেখার মতো। শনিবারের ভূমিকম্পের উৎপত্তি স্থল সিলেটে জৈন্তাপুরে। তবে, সবগুলোই ভূমিকম্প ছোট ধরনের।

তিনি বলেন, ভূমিকম্পের প্রি-শক ও আফটার-শক থাকে। অনেক সময় বড় ভূমিকম্পের আগে ছোট কম্পন হয়। আবার বড় ভূমিকম্প হলে তারপর ছোট ছোট কম্পন হয়। তাছাড়া প্রিসক কম্পন হলে একটি লাভ আছে, তা হলো বড় ভূমিকম্পন হওয়ার আশঙ্কা থাকলে সেগুলোর শক্তি অনেকটা কমে আসে। এরপরও যেহেতু সিলেট অঞ্চল ভূমিকম্প প্রবণ। সেজন্য সতর্ক থাকতে হবে। তাছাড়া ওই অঞ্চলে বড় ভূমিকম্পের ইতিহাস আছে।

ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণকেন্দ্রের বিগত ৩ বছরের রেকর্ডের বরাত দিয়ে তিনি বলেন, ২০১৯ সালের ১৩ জানুয়ারি সিলেটে ২ দশমিক ৭ রিখটার স্কেলে ভূমিকম্প হয়েছে। ঢাকা থেকে এর দূরত্ব ছিল ১৯৭ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে। ২০২০ সালের ২৭ জানুয়ারি রিখটার স্কেলে ৪ দশমিক ১ মাত্রায় ভূমিকম্প হয়। এর উৎপত্তি স্থল ছিল সিলেটের গোয়াইনঘাটে। ঢাকা থেকে এর দূরত্ব ছিল ২০৫ কিলোমিটার। একই বছরে ১৩ এপ্রিল ৩ দশমিক ৬ মাত্রায় সিলেটে ভূ-কম্পন অনুভূত হয়। এটাও ছিল সিলেটের কাছে। ঢাকা থেকে এর দূরত্ব ছিল ২১৮ কিলোমিটার।

ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণকেন্দ্রের তথ্য মতে, শনিবার ১০টা ৩৬মিনিটে প্রথম ভূমিকম্পের রিখটার স্কেল ছিল ৩ দশমিক শূন্য। দ্বিতীয় ঝাঁকুনি ১০টা ৫০ মিনিট ৫৩ সেকেন্ডে রিখটার স্কেলে ৪ দশমিক ১ মাত্রা ছিল। ১১টা ২৯মিনিট ৫৩ সেকেন্ডে ২ দশমিক ৮ মাত্রায় ভূমিকম্প অনুভূত হয়। এছাড়া দুপুর ২টায় ৪ মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হয়। চারটিরই উৎপত্তি স্থল সিলেটের আশপাশে। ঢাকা থেকে উত্তর পূর্বে এর অবস্থান। ডিউকি ফল্টের কারণে সিলেট ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা। যে কারণে জৈন্তাপুর সীমান্তের দিকেই এর উৎপত্তি স্থল!

ইউকে/এসএম