চারঘাট (রাজশাহী) সংবাদদাতা: কৈশোরে এক তরুণীর প্রেমে পড়েছিলেন রায়হান আলী (১৯)। তাদের সেই সম্পর্ক মেনে নেয়নি পরিবার। বিপরীতে কড়া শাসন করেছেন। এতে চরম মানসিক যন্ত্রণায় ভুগতে থাকে রায়হান।
এলাকা সূত্রে জানা যায়, মানসিক বিপর্যয়ের একপর্যায়ে খাওয়া-দাওয়া প্রায় বন্ধ হয়ে যায় তাঁর। এতে সে অসুস্থ হয়ে পড়ে। তাঁর হতদরিদ্র পরিবার বিভিন্ন পল্লি চিকিৎসকদের দ্বারস্থ হয়েও কোনো লাভ হয়নি।
পরিবারের দাবি রায়হান এখন পুরোপুরি মানসিকভাবে অসুস্থ। অর্থ সংকটের কারণে তাঁর সঠিক চিকিৎসাও করাতে পারছেন না তারা। মানুষের জানমালের ক্ষতির আশঙ্কায় রায়হানের পায়ে শিকল পরিয়ে গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে।
রায়হান আলী রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার সদর ইউনিয়নের পশ্চিম কান্দ্রা গ্রামের দুলাল মণ্ডলের একমাত্র ছেলে। আজ শুক্রবার সকালে রায়হান আলীর বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, দুটি বেড়া দিয়ে তৈরি ঘর। একটি ঘরে তার ছোট বোন ও দাদি থাকেন। অন্য ঘরে বাবা-মা ও সবার ছোট আরেকটি বোন থাকেন।
আর মানসিকভাবে অসুস্থ রায়হানের ডান পায়ে শিকল পরিয়ে বাড়ির উত্তরপাশের আম গাছের সঙ্গে তালা লাগিয়ে রাখা হয়েছে। সেখানে রাখা হয়েছে টিনের তৈরি একটি চৌকি। রায়হানের চারপাশে মশার উপদ্রব। কিন্তু সেখানে মশা নিয়ন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থা নেই। গত এক বছর ধরে এভাবেই গাছের সঙ্গে শিকল বেঁধে রাখা হয়েছে রায়হানকে।
পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলার একপর্যায়ে তাঁর ছবি তুলতে গেলে সে নিজেই বিভিন্ন ভঙ্গিতে ছবি তোলার পরামর্শ দেন। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যেই সে ছবি তোলার কারণে শুরু করে অশ্লীল ভাষায় গালাগাল। সে সময় তাঁর ছোট বোন নিলা খাতুন পানি পান করতে দিলে সে শান্ত হয়।
এ বিষয়ে তাঁর দাদি সাজেদা বেওয়া বলেন, ‘রায়হানের যখন ১০ বছর বয়স তখন তার মা মারা যায়। সে সময় তিনি ৫ম শ্রেণির ছাত্র। মা মারা যাওয়ার পর থেকে সে নানির বাড়িতেই থাকত। গত দুই বছর আগে নানির বাড়ির পাশে এক মেয়ের প্রেমে পড়ে রায়হান। কিন্তু তাদের সম্পর্ক নানির বাড়ির লোকজন মেনে না নেওয়ায় মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে সে। এরপর থেকে সে অসুস্থ। অসুস্থ হওয়ার কয়েক দিন পর সে পুরোপুরি পাগল হয়ে যায়। রাস্তার মানুষজন দেখলেই মারধর গালাগালি ও বাড়িতে ভাঙচুর শুরু করে। এই কারণে তাঁর পায়ে শিকল পরিয়ে গাছে সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে।’
এনামূল হক নামের এক প্রতিবেশী বলেন, ‘রায়হান সম্পর্কে আমার ভাতিজা হয়। ছোটবেলা থেকে সে খুবই শান্ত ও মেধাবী ছিল। তবে তাঁর মা মারা যাওয়ার পর বাবা আবার বিয়ে করেন। অভাবের সংসারে রায়হানের পড়ালেখা বন্ধ হয়ে গেলে তাঁর ঠাঁই হয় নানির বাড়িতে। সেখানে প্রায় দুই বছর আগে অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে আবার বাবার বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এখন সে মানসিকভাবে অসুস্থ। অভাব অনটনের সংসারে তাঁর বাবা ঠিকমতো চিকিৎসা করাতে পারছেন না। হয়তো ভালো চিকিৎসা পেলে সুস্থ হতেও পারে সে।’
এ বিষয়ে তাঁর বাবা দুলাল মণ্ডল বলেন, ‘আমার প্রথম স্ত্রীর দুই ছেলে-মেয়ে। স্ত্রী মারা যাওয়ার পর আমি আবার বিয়ে করি। দ্বিতীয় পক্ষের আরেকটি মেয়ে আছে। আমাদের একমাত্র বাড়িতে ৫ শতক জমি আছে। সেখানে ভাইকে ভাগ দিলে আমার অংশ মাত্র আড়াই শতক। মানুষের জমিতে কাজ করে সংসার চালাই। তার মধ্যে মেয়েদের লেখাপড়ার খরচ দিতে গিয়ে রোজগারের বেশির ভাগ টাকা খরচ হয়ে যায়। যে কারণে অভাব অনটনের মধ্যে কোনো মতে খেয়ে না খেয়ে দিন যায় আমাদের। আমার একমাত্র ছেলে অসুস্থ হয়ে এখন পাগল প্রায়। টাকার অভাবে তাঁর সুচিকিৎসাও করাতে পারছি না। যখন কিছু টাকার জোগাড় করতে পারি, রায়হানকে তখন ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই। ঠিকমতো ওষুধ খাওয়ালে কিছুদিন ভালো থাকে সে।’
শিকলে বেঁধে রাখার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘রায়হানকে ছেড়ে দিলে বাড়িতে ভাঙচুর ও যাকে সামনে দেখে তাকেই মারধর করে। যার কারণে তাঁর পায়ে শিকল বেঁধে রাখা হয়েছে। সেখানেই তার খাওয়া-দাওয়া ও থাকা। শুয়ে থাকার জন্য একটি চৌকি দেওয়া হয়েছে।’
এ বিষয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. আবদুর মতিন বলেন, অসুস্থতার কারণে এক যুবক শিকল বন্দী, এমন খবর আমার জানা নেই। তবে ওই রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে আসলে দেখে বলা যাবে তার কি সমস্যা।’
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নুরুল হাই মোহাস্মদ আনাছ বলেন, মানসিক অসুস্থতার কারণে এক যুবককে বেঁধে রাখা হয়েছে আর অর্থ সংকটের কারণে চিকিৎসা করাতে পারছে না। এ বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে ওই পরিবার আমার সঙ্গে যোগাযোগ করলে সার্বিকভাবে সহায়তা করা হবে।’
ইউকে/এএস