বার্তাকক্ষ প্রতিবেদন: ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জ উপজেলার খনগাঁও ইউনিয়নের ঘিডোব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভোটগণনার পরে কারচুপির অভিযোগে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এ সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে ৩ জন নিহত ও পৃথক ঘটনায় কমপক্ষে ৯ জন আহত হয়েছেন বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে।
গতকাল রোববার রাতে পীরগঞ্জ উপজেলার খনগাঁও ইউনিয়নের ঘিডোব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে এই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।
গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহতরা হলেন-ঘিডোব গ্রামের সাহাবলি হোসেন (৩৫), মোজাহারুল ইসলাম (৪০) ও অবিনাশ চন্দ্রের ছেলে আদিত্য রায় (২০)। ঘটনাস্থলেই দুইজন এবং রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে একজনের মৃত্যু হয়।
চলমান ইউপি নির্বাচনের তৃতীয় ধাপে ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী ও পীরগঞ্জ উপজেলার ১৮টি ইউনিয়নে ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া সুষ্ঠুভাবে ভোট গ্রহণ শেষ হলেও গণনা নিয়ে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ ওঠে।
ঘিডোব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের দায়িত্বে থাকা সরকারি বণিক বালিকা বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মো. জামাল উদ্দিন জানান, ভোট গ্রহণ ও গণনা শেষে কিছু মানুষ ভোটে কারচুপির অভিযোগ তোলেন। বিষয়টি মুহূর্তের মধ্যে চাউর হয়ে গেলে এলাকার বিক্ষুব্ধ লোকজন ভোটকেন্দ্র ঘেরাও করে স্লোগান দিতে থাকে। বিষয়টি ঊর্ধ্বতনদের জানানো হলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ স্ট্রাইকিং ফোর্সের সদস্যরা ঘটনাস্থলে পৌঁছান।
এ সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সহযোগিতায় ভোটের মালামাল নিয়ে প্রিসাইডিং অফিসার ও অন্যরা কেন্দ্র থেকে উপজেলা শহরে চলে যান।
স্থানীয়রা জানায়, পীরগঞ্জ উপজেলার খনগাঁও ইউনিয়নরে ঘিডোব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোট কেন্দ্রে ভোট গণনাকে কেন্দ্র করে রাত ৮টার দিকে চেয়ারম্যান প্রার্থী নুরুজ্জামানের সর্মথকেরা প্রিসাইডিং অফিসারসহ প্রশাসনের কর্মর্কতাদের ওপর হামলা ভাঙচুর শুরু করেন। খবর পেয়ে পীরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) স্ট্রাইকিং ফোর্সসহ ঘটনাস্থলে পৌঁছালে তাঁদের লক্ষ্য করে উত্তেজিত জনতা ইট পাটকেল নিক্ষেপ করে। নির্বাচনের দায়িত্বে থাকা প্রশাসনের গাড়ি ভাঙচুর করা হয় এবং প্রশাসনের গাড়ি থামানোর চেষ্টা চালায়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গুলি চালায়। গুলিতে ঘটনাস্থলে মারা যান হাবিবপুর গ্রামের সাহাবলি ওরফে হুসনে (৩৫) ও মাজাহারুল ইসলাম (৪০)। আজ সোমবার সকালে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পথে গুলিবিদ্ধ কলেজ ছাত্র আদিত্যর (১৮) মৃত্যু হয়।
আহতরা হলেন-উপজেলার ঘিডোব গ্রামের অবিলাশের ছেলে অমিত রায়, জহুরুলের ছেলে সবুজ আলী, তমিউদ্দীনের ছেলে সুজা আহম্মেদ, আব্দুল বাকির স্ত্রী রহিমা বেগম ও খনগাঁও গ্রামের তৈয়বুর রহমানের ছেলে রাব্বানী। তারা ঠাকুরগাঁও আধুনিক সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। দুই জনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
ঠাকুরগাঁও আধুনিক সদর হাসপাতালের আবাসিক কর্মকর্তা রাকিবুল ইসলাম চয়ন বলেন, ‘গুলিবিদ্ধ চারজনের মধ্যে দুজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। তাঁদের রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।’
গ্রামপুলশি সদস্য সগন্দ্রেনাথ জানান, উপজেলার বৈরচুনা ইউনিয়নের ইন্দ্রোইল (শিববাড়ি) সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোট কেন্দ্রে রাত ৯টার দিকে মোরগ মার্কার মেম্বার প্রার্থীর সমর্থকেরা প্রিসাইডিং অফিসারসহ প্রশাসনের র্কমর্কতাদের প্রায় দেড়ঘণ্টা অবরুদ্ধ করে রাখে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বিজিবিসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ঘটনাস্থলে এলে তাঁদের ওপরও আক্রমণ করে। উত্তেজিত জনতার ছোড়া ইটপাটকেলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ নির্বাচনে দায়িত্বরত কয়েকজন আহত হয়েছেন বলে দাবি করেছেন জেলা প্রশাসক মাহবুবুর রহমান।
এ ব্যাপারে কেন্দ্রের দায়িত্বে থাকা হরিপুর থানার এসআই আবু হানিফ মণ্ডল বাদী হয়ে এলাকার ৭০০ জনের বিরুদ্ধে আজ সোমবার পীরগঞ্জ থানায় মামলা করেছেন। তবে মামলায় কারও নাম উল্লেখ করা হয়নি।
মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, স্ট্রাইকিং ফোর্সের মাইক্রোবাস ভাঙচুর করে উত্তেজিত জনতা। পরিস্থিতি ক্রমে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। নিজেদের যানমাল ও সরকারি সম্পদ রক্ষার স্বার্থে কর্তব্যরত ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশে নায়েক সুবেদার আজাহার আলীসহ ১৪ জন বিজিবি সদস্য ৪৭ রাউন্ড গুলি বর্ষণ করেন। বিজিবির গুলিতে এলাকার শাহাবুদ্দিন ওরফে সাহাবুলি (৩২), মো. মুজা (৩৮) ও পরাগ আলী (২২) ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান। এ ছাড়া আরও ৬ জন গুলিবিদ্ধ হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এ নিয়ে এলাকায় এখনো জনমনে আতঙ্ক বিরাজ করছে।
পীরগঞ্জ থানার ওসি জাহাঙ্গীর আলম জানান, বিজিবি কর্তৃপক্ষ যানমাল ও সরকারি সম্পদ রক্ষার্থে গুলি বর্ষণ করেছে। অপরাধীদের শনাক্ত করার জন্য নিরপেক্ষ তদন্ত চলছে। নির্বাচনী সহিংস ঘটনার পৃথক পৃথক মামলার প্রস্তুতি চলছে। গুলিতে নিহতদের মরদেহ ময়নাতদন্তের পর পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হবে।
এদিকে পুলিশি হয়রানির ভয়ে পুরুষেরা গ্রাম ছাড়া বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
গুলিতে তিনজন নিহত হওয়ার তথ্য নিশ্চিত করে ঠাকুরগাঁও পুলিশ সুপার (এসপি) জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা সদস্যরা কোনোভাবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছিলেন না। তাঁদের ওপরে হামলা করা হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে বাধ্য হয়ে বিজিবি গুলি ছুড়েছে। এতে ঘটনাস্থলে একজন নিহত হয়েছেন।’
এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. রেজাউল করিম জানান, ‘পীরগঞ্জ একটি শান্ত এবং শান্তিপ্রিয় এলাকা এবং এটি একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। আমি বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি।’
উল্লেখ্য, খনগাঁও ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা মার্কার প্রার্থী সহিদ হোসেন ৬ হাজার ৫৮২ ভোট পেয়ে জয়যুক্ত হয়েছে। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি নেতা নুরুজ্জামান হক চশমা মার্কায় পেয়েছেন ৩ হাজার ৪৫ ভোট।
ইউকে/এসই/এসএম