কুরিয়ারের গাফিলতি, পথেই পচছে গ্রাহকের আম!

বিশেষ প্রতিবেদক: আমের রাজধানীখ্যাত রাজশাহী ও এর আশপাশের উপজেলাতে এবার আমের ফলন ভালো হয়েছে। ভরা মৌসুমে এখন তাই চারিদিকে কেবল রসালো আম আর আম। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে জেলার আম যাচ্ছে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে।

তবে করোনা পরিস্থিতির কারণে দেশ জুড়েই চলছে লকডাউন। এর ওপর রাজশাহীতে চলছে ‘সর্বাত্মক লকডাউন’। তাই আম পরিবহন ও দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আম পাঠাতে এখন অন্যতম মাধ্যম হয়ে উঠেছে কুরিয়ার সার্ভিস। কিন্তু সেখানেও স্বস্তি নেই! কুরিয়ার সার্ভিসগুলোর গাফিলতিতে পথেই পচে নষ্ট হচ্ছে রাজশাহী থেকে পাঠানো গ্রাহকের আম।

ব্যবসায়ীরা সরাসরি বাগান থেকে আম সংগ্রহ করে কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন জেলায় পাঠাচ্ছেন। এছাড়া স্থানীয়রাও আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতে আম পাঠাতে আশ্রয় নিচ্ছেন কুরিয়ার সার্ভিসের। এতে প্রতিদিন শত শত টন আম যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন এলাকায়। কিন্তু আম সঠিক সময়ে না পৌঁছানো, যত্নের অভাব, কর্মীদের অসদাচারণসহ এসব কুরিয়ার সার্ভিসের বিরুদ্ধে গ্রাহকদের অভিযোগ বিস্তর। আম ডেলিভারি দিতে দেরি করায় পচে নষ্ট হয়ে যাওয়ার অসংখ্য অভিযোগ করছেন গ্রাহকরা।

রাজশাহীতে কার্যক্রম পরিচালনা করছে এমন কয়েকটি কুরিয়ার সার্ভিসের সঙ্গে আলাপ করে আম পরিবহনে তাদের কাজের এমন সব তথ্য জানা যায়। বিভিন্ন মোকামে শাখা বসিয়ে হাজার হাজার প্যাকেট আম বুকিং নিচ্ছে বেশ কয়েকটি কুরিয়ার সার্ভিস। এসব কুরিয়ারের মাধ্যমে প্রতিদিন শত শত টন আম দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পৌঁছানো হচ্ছে। ইউএসবি, এজেআর, করতোয়া, আহমেদ, জননীসহ আরও কিছু কুরিয়ার সার্ভিস রাজশাহী থেকে ঢাকায় আম পরিবহনে কেজিতে চার্জ নেয় ৮ টাকা।

এসএ পরিবহনে প্রতি কেজি আম ঢাকায় পাঠাতে খরচ হয় ১৫ টাকা, ঢাকার বাইরে ২০ টাকা ও উত্তরবঙ্গে ১২ টাকা। সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসে ঢাকায় ১২ টাকা কেজি এবং ঢাকার বাইরে ১৬ টাকা কেজি। অথচ উচ্চহারে চার্জ আদায়কারী এ দু’টি কুরিয়ার সার্ভিসেই সবচেয়ে বেশি গ্রাহক হয়রানির অভিযোগ।

জানা যায়, গত ২ জুন সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসের রাজশাহী আলুপট্টি শাখা থেকে ঢাকায় সাফায়াত জামিল নামে এক ক্রেতার কাছে ৬০ কেজি আম পাঠান ব্যবসায়ী আবু ছিদ্দিক। তিনি অনলাইনে আমের ব্যবসা করছেন। সেই আম গ্রাহকের কাছে পৌঁছায়নি। আবার তার কাছে ফেরতও আসেনি। আবু ছিদ্দিক প্রতিষ্ঠানটির হটলাইনে বিষয়টি নিয়ে অভিযোগ দেওয়ার জন্য ফোন করলে নম্বরেও পাননি সংযোগ।

আবু ছিদ্দিক বলেন, তিনটি ক্যারেটে ২০ কেজি করে ৬০ কেজি গোপালভোগ আম পাঠিয়েছি। সুন্দরবন কুরিয়ারের শ্যামলী শাখায় পাঠানো হয়। নাম, ঠিকানা ও মোবাইল নম্বর সঠিকভাবে মিলিয়ে সুন্দরভাবে ক্যারেটে প্যাকিং করে আম পাঠালেও তা প্রাপকের কাছে পৌঁছে দেয়নি সুন্দরবন কুরিয়ার। এমনকী কুরিয়ার অফিস থেকে কল-এসএমএসও করা হয়নি। শ্যামলী শাখায় যোগাযোগ করলে আম সেখানে নেই বলে জানানো হয়। রাজশাহী শাখায় অভিযোগ করলেও কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। পরে গ্রাহককে জরিমানা হিসেবে আমাকে ২০ কেজি আম পাঠাতে হয়েছে।

গত ২৮ মে রাজশাহী থেকে সুন্দরবন কুরিয়ারের মাধ্যমে ঢাকার মিরপুর-১০ শাখায় আম পাঠান আম ব্যবসায়ী মো. সম্রাট হোসেন। আমের পার্সেল পরদিনই অর্থাৎ ২৯ মে পৌঁছায় ঢাকার মিরপুর-১০ শাখায়। রিসিভ করেন ওই শাখার ইনচার্জ মাসুদুর রহমান। কিন্ত আমের প্রাপক নুরুল ইসলামের কাছে কুরিয়ার অফিস থেকে কল-এসএমএসও করা হয়নি। প্রতিষ্ঠানটির গাফিলতিতে আম হাতে পাননি তিনি। তবে প্রতিষ্ঠানটি আম হারিয়ে যাওয়ার দায় স্বীকার করেছে।

সম্রাট হোসেন বলেন, ৩১ মে আমি কুরিয়ার অফিসে যোগাযোগ করি এবং জানতে পারি আম কুরিয়ার অফিসেই রয়েছে। এসময় তৎক্ষণাৎ সুন্দরবনের মিরপুর-১০ শাখায় একজনকে পাঠাই। ততক্ষণে পচে নষ্ট হয়ে যায় আম। সেসময় কুরিয়ারের লোকজনও আমার প্রতিনিধিকে জানায়, আম পচে গেছে।

এ বিষয়ে সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসের ঢাকা মিরপুর-১০ শাখায় যোগাযোগ করা হলে সেখানকার ইনচার্জ মাসুদুর রহমান তাদের অফিসে আম পঁচে নষ্ট হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, আমাদের অফিসে আম পৌঁছার পরপরই প্রাপকের মোবাইল নম্বরে এসএমএস দেওয়া হয়েছিল। নম্বরটি ভুল হওয়ায় প্রাপক আম পৌঁছার বিষয়টি জানতে পারেননি। পরে জানা যায় নম্বরটি ভুল। প্রাপককে না পেলে পণ্য প্রেরকের কাছে ফেরত পাঠানো হয়। তবে আম ফেরত পাঠানোর নিয়ম নেই।

শুধু রাজশাহী নয় দেশের অন্য জেলা থেকে আম ও লিচু পরিবহনে গাফিলতি করছে কুরিয়ার সার্ভিস প্রতিষ্ঠানগুলো। গত ২৬ মে দিনাজপুরের বীরগঞ্জ থেকে এক হাজার লিচু কেনেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মঈন উদ্দিন‌। এদিন লিচুগুলো সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে লিচু বিক্রেতা কক্সবাজারে তার কাছে পাঠান। এর ৫ দিন পর কক্সবাজার শাখা থেকে লিচু ডেলিভারি দেওয়া হয়। ডেলিভারি দিতে দেরি করায় সব লিচু নষ্ট হয়ে যায়।

মঈন উদ্দিন‌ বলেন, সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসে পণ্য বুকিং দিলে তার অবস্থান ট্র্যাকিং করা যায়। আমি ট্র্যাকিং করে দেখলাম ৩ দিন ধরে সেগুলো ঢাকায় তাদের কামারপাড়া অফিসে পড়ে আছে। পরে তাদের হটলাইন নম্বর ও কামারপাড়া অফিসে ফোন করে দ্রুত ডেলিভারি দিতে বলি। সব মিলিয়ে ৫ পর দিন তারা আমাকে ডেলিভারি দিয়েছে। দেরি হওয়ায় সব লিচু নষ্ট হয়ে যায়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজশাহীতে সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসের স্থায়ী শাখা ছাড়াও আম মৌসুমে প্রতিটি উপজেলা ও আমের হাটে এজেন্ট শাখা খোলা হয়েছে। আম বুকিং দিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হচ্ছে। প্রতিদিন এই কুরিয়ার সার্ভিস বহন ক্ষমতার কয়েকগুণ বেশি আমের বুকিং নিচ্ছে। ফলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ঢাকায় ডেলিভারি করার কথা বলা হলেও গন্তব্যে আম পৌঁছাতেই লাগছে কয়েকদিন।

আবার যেনতেন করে আমের প্যাকেট যেখানে সেখানে গাদাগাদি করে ফেলে রাখা হচ্ছে। ফলে পড়ে থেকে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে আম। আম ভালোভাবে পৌঁতে এখন সবাই বাড়তি দাম দিয়ে ঝুড়ির বদলে প্লাস্টিকের ক্যারেটে আম পাঠাচ্ছেন। কিন্তু সেই প্লাস্টিকের ক্যারেট ভেঙে ফেলছেন কুরিয়ার সার্ভিসের কর্মীরা। তারা আম নামানোর সময় পিকআপ ভ্যান থেকে আমের ক্যারেট ছুড়ে মাটি ফেলছেন। এতে ক্যারেটও ভেঙে যাচ্ছে আবার আমও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বারবার অভিযোগ করেও তা আমলে নিচ্ছে না সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিস!

এদিকে, গত ১১ জুন বিকেলে রাজশাহীর বানেশ্বরে এসএ পরিবহনে আম কুরিয়ার করছেন নজমুল হোসেন। তিনি বলেন, কার্টনসহ ২২ কেজি আম ঢাকায় পাঠাবো। ৩৩০ টাকা খরচ পড়েছে। অন্য কুরিয়ারের তুলনায় এসএ পরিবহনের চার্জ অনেক বেশি। কিন্তু ক্রেতার সুবিধার্থে বাধ্য হয়ে পাঠাতে হচ্ছে।

অনলাইন আম ব্যবসায়ী সাইফুর রহমান বলেন, ক্রেতাদের খরচ কিছুটা কমাতে ফলের কার্টন প্যাকেট করে সুন্দরবন কুরিয়ারে পাঠাই। প্রতিদিন প্রায় ২০-২৫ মণ আম কুরিয়ারে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পাঠাই। ৩-৫ দিন পর ক্রেতাদের হাতে আম পৌঁছায়। আম পাওয়ার পর প্রায়ই ক্রেতারা ফোন করে অভিযোগ করেন আমে পচে গেছে।

জানতে চাইলে সুন্দরবনের কুরিয়ার সার্ভিসের উত্তরাঞ্চলের দায়িত্বে নিয়োজিত উপ-মহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) মো. আলতাফ হোসেন বলেন, আমের মৌসুমে বুকিংয়ের চাপ বেশি। সড়কে যানজটে কারণে গাড়ি পৌঁছাতে দেরি হয়। আবার করোনার কারণে জনবল সংকটও আছে। ফলে গাড়ি ঢাকায় পৌঁছালেও জনবলের অভাবে খালাস করা যাচ্ছে না। এসব কারণে আম সময়মতো ডেলিভারি দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তবে কারও পার্সেল হারিয়ে গেলে আমরা ক্ষতিপূরণ দিচ্ছি।

ইউকে/এসই/এসএম