বার্তাকক্ষ প্রতিবেদন: রাজধানীর একটি গাড়ির শোরুমের কর্মচারী অমিত হাসান। স্বামী-স্ত্রী, ছোট এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে চারজনের সংসার। গতকাল সোমবার দুপুরে পুরান ঢাকার মৌলভীবাজারের একটি মুদিদোকান থেকে কিনছিলেন নিত্যপণ্য। কিন্তু পকেটের সঙ্গে বাজারের থলের হিসাব মেলাতে হিমশিম খাচ্ছিলেন। কোনটা কমাবেন, কোনটা না হলে নয়, তা ঠিক করতে বারবার ফোন করছিলেন বাসায়।একটু এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসু চোখে তাকাতেই হেসে দিয়ে অমিত হাসান বলে ফেললেন, ‘আর বইলেন না ভাই। এক বছর আগেও দুই হাজার টাকার চাল-আটা আর তেল-চিনির বাজারে এক সপ্তাহ চলে যেত। কিন্তু এখন বাজারে এলে মনে হয়, পাঁচ হাজার টাকায়ও কুলানো যাবে না। সামনে আরও কী যে অপেক্ষা করছে বুঝতে পারছি না।’
বাজারে দাম বাড়ছে না এমন পণ্য এখন খুঁজে পাওয়া মুশকিল। কিন্তু এর মধ্যে কয়েক মাস ধরে দুটি পণ্যের দাম যেন একেবারে লাগামছাড়া ছুটছে। দোকানে গেলে মনে হয়, দোকানদার প্রতিদিন ইচ্ছেমতো দামে বিক্রি করছেন। এর মধ্যে চিনির দাম দুই দফায় বাড়িয়ে সরকার বেঁধেও দিয়েছে। কিন্তু কিসের কি, চিনির দাম চড়ছে চড়চড় করে। ব্যবসায়ীরাই বলছেন, বাজারে চিনি, আটার দাম বারবার রেকর্ড করছে। এরপরও বাজারে চিনি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সরকার খোলা চিনির দাম বেঁধে দিয়েছিল ৯০ টাকা কেজি। অথচ বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১১২-১১৫ টাকায়, প্যাকেটজাত চিনি ৯৫-৯৯ টাকা। কিন্তু বাজারে প্যাকেট চিনি উধাও।
মৌলভীবাজারে চিনি ব্যবসায়ী ও লালবাগের বাসিন্দা হাজি আবুল হোসেন প্রায় ৪০ বছর ধরে তেল-চিনির পাইকারি ব্যবসা করেন। এক মাস ধরে তিনি চিনি বিক্রি বন্ধ রেখেছেন। বাসায় খাওয়ার জন্য লালবাগ কেল্লার আশপাশের কয়েক দোকান ঘুরেও তিনি প্যাকেটজাত চিনির সন্ধান পাননি। পরে দূরের একটি দোকান থেকে ১২০ টাকায় দুই কেজি চিনি সংগ্রহ করেন।
গতকাল রাজধানীর কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, খোলা চিনি খুচরা পর্যায়ে বিক্রি হয়েছে ১১২-১১৫ টাকায়। অথচ সরকারনির্ধারিত খুচরা চিনির দাম ছিল ৯০ টাকা। বেসরকারি মিলের প্যাকেটজাত চিনির দাম ৯৫ টাকা এবং সরকারি মিলের ৯৯ টাকা। কিন্তু কোথাও প্যাকেট চিনি নেই। স্বপ্ন সুপারশপের আজিমপুর শাখার একজন কর্মকর্তা জানান, তাঁদের আউটলেটে গত এক মাস ধরে প্যাকেটজাত চিনির সরবরাহ নেই।
মৌলভীবাজারের পাইকারি ব্যবসায়ী হারুন-উর-রশিদ জানান, বাজারে কোনো পণ্যেরই সংকট নেই। যে পরিমাণ পণ্য দেশে মজুত আছে, তা নিয়ে কয়েক মাস চালানো সম্ভব। কিন্তু সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে দেশে দুর্ভিক্ষের আভাস দেওয়া হচ্ছে। সেই সুযোগ নিচ্ছেন বড় ব্যবসায়ীরা।
রাজধানীর খুচরা আটা ব্যবসায়ীরা জানান, তিন-চার মাস আগেও প্রতি কেজি খোলা আটার দাম ছিল ৩০ টাকা। বর্তমানে তা দ্বিগুণ দামে অর্থাৎ ৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এক বছর আগে প্রতি কেজি প্যাকেট আটার দাম ছিল ৩৫-৪০ টাকা, বর্তমানে তা ৬৬ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
মৌলভীবাজারের খুচরা চিনি ও আটা ব্যবসায়ী সিরাজুল ইসলাম জানান, চিনি ও আটার কোনো অর্ডার নিচ্ছেন না ডিলাররা। আটার দাম আরও বাড়তে পারে, এটা ধরে নিয়ে কোম্পানিগুলো অর্ডার নেওয়া বন্ধ রেখেছে। সরকারি চিনিও পাওয়া যাচ্ছে না। দামও অনেক চড়া। প্রতি কেজি খোলা দেশি চিনি ১১৬-১১৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বছরে চিনির চাহিদা ১৮-২০ লাখ টন। এর মধ্যে দেশে উৎপাদিত হয় ৩০-৩৫ হাজার টন। অপরিশোধিত চিনির পাশাপাশি ৩৫-৪০ হাজার টন পরিশোধিত চিনি আমদানি হয়। ৩ নভেম্বরের তথ্য অনুযায়ী, দেশের সিটি, মেঘনা, এস আলম, আব্দুল মোনেম ও দেশবন্ধু গ্রুপের কাছে ৩ লাখ ৭৫ হাজার ৬৭৫ টন চিনি মজুত রয়েছে। এ ছাড়া অপরিশোধিত চিনি মজুত রয়েছে ১ লাখ ৫৪ হাজার ৭৫ টন এবং পাইপলাইনে রয়েছে ২ লাখ ২১ হাজার ৬০০ টন।
৩ নভেম্বর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বছরে গমে চাহিদা প্রায় ৭০ লাখ টন। দেশে উৎপাদিত হয় ১২ লাখ ৩৪ হাজার টন আর আমদানি হয় ৬৫ লাখ টন। ২০২১ সালে এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত গম আমদানি হয়েছিল ২৯ লাখ ৫৪ হাজার টন। আর চলতি বছরের এপ্রিল-সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আমদানি হয়েছে ২ লাখ ৩৩ হাজার টন। ২০২১ সালে চাল আমদানি হয়েছিল ১ লাখ ১৬ হাজার টন এবং চলতি বছর আমদানি হয়েছে ১ লাখ ৯৩ হাজার টন।
পাইকারি চিনি ব্যবসায়ীরা জানান, ভারতে প্রতি কেজি চিনি ৪০ রুপিতে বিক্রি হচ্ছে। আগে চিনি রপ্তানিতে সে দেশের সরকারের অনুমোদন দরকার ছিল। বর্তমানে রপ্তানির নিষেধাজ্ঞা তুলে দিয়েছে। এতে স্বল্প সময়ের মধ্যে চিনি আমদানি করা সম্ভব। বাজারের ঘাটতি পূরণে এখনই পদক্ষেপ নিলে ভবিষ্যতে সংকট চরম আকার ধারণ করবে।
পাইকারি চিনি ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর আলম জানান, সরকারনির্ধারিত দামে কোথাও চিনি পাওয়া যাচ্ছে না। মিল থেকে প্রতি কেজি চিনি ১০০ টাকা চাওয়া হচ্ছে। বেশি দামে কিনে তা বিক্রি করলে ভোক্তা অধিদপ্তর জরিমানা করবে। এমন ভয়ে অনেকেই বিক্রি বন্ধ রেখেছেন।
জানতে চাইলে জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান আজকের পত্রিকাকে বলেন, বাড়তি দামে সিটি গ্রুপ চিনি বিক্রি করেছে। তাদেরকে কারণ দর্শানোর নোটিশ করা হচ্ছে। অন্যান্য কোম্পানির বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিত সাহা বাড়তি দামে চিনি বিক্রির বিষয়টি অস্বীকার করেন। বাজারে চিনি সরবরাহের বিষয়ে তিনি বলেন, তাঁদের মিল থেকে দিনে ১৬০০-১৮০০ টন চিনি সরবরাহ করা হচ্ছে।
ইউকে/এসএম