বার্তাকক্ষ প্রতিবেদন: পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম অপরিবর্তিত রাখার ঘোষণার এক মাস যেতে না যেতেই আরেক দফা দাম বাড়ালো বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। স্বাভাবিকভাবেই এখন গ্রাহক পর্যায়ে দাম বাড়াবে বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলো। ইতোমধ্যে দু-একটা কোম্পানি দাম বাড়ানোর প্রস্তুতিও নিচ্ছে বলে জানা গেছে।
এমন এক সময় এই বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলো যখন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের বিষয়টি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। তাদের অন্যতম শর্ত হলো বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ভর্তুকি কমাতে হবে। আবার এই মুহূর্তে নিত্যপণ্যের মূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে দিশেহারা মানুষ। জ্বালানি সংকটে অনেকটা টালমাটাল অবস্থা শিল্প খাতে।
তাহলে কি কারণে অপরিবর্তিত রাখার ঘোষণার অল্প কিছুদিনের মাথায় আবার দাম বাড়ানো হলো, তা নিয়ে দেখা দিয়েছে নানা প্রশ্ন। অনেকে বলছেন, নিয়ম ভেঙে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি করেছে বিইআরসি। আবার কেউ কেউ মনে করছেন দাতা সংস্থাগুলোর চাপে পড়েই বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে সাংবিধানিক এই প্রতিষ্ঠানটি।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সোমবার (২১ নভেম্বর) পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের প্রতি ইউনিট ৫ টাকা ১৭ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৬ টাকা ২০ পয়সা নির্ধারণ করে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। এতে করে পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ল ১৯ দশমিক ৯২ শতাংশ। কমিশন জানিয়েছে, দাম বাড়ানোর পরও বিদ্যুতের উৎপাদন পর্যায়ে ভর্তুকি ১৭ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দেবে সরকার।
এর আগে গত ১২ জানুয়ারি বিদ্যুতের পাইকারি দাম পুনর্নির্ধারণের প্রস্তাব জমা দেয় পিডিবি। এরপর ১৮ মে তাদের প্রস্তাবের ওপর গণশুনানি করা হয়। সেদিন পিডিবি গণশুনানিতে পাইকারি বিদ্যুতের দাম ৬৫ দশমিক ৫৭ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব দেয় এবং বিইআরসির কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি ভর্তুকি না দিলে ৫৭ দশমিক ৮৩ শতাংশ বাড়ানোর সুপারিশ করেছিল। আর ভর্তুকি দিলে বাড়ানোর প্রয়োজন নেই বলেও তারা সুপারিশ করে।
গণশুনানির পর ৯০ কর্মদিবসের মধ্যে আদেশ দেওয়ার আইনি বাধ্যবাধকতা থাকায় গত ১৩ অক্টোবর বিদ্যুতের পাইকারি দাম অপরিবর্তিত রেখে সিদ্ধান্ত দেয় বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। তবে কমিশন সে সময় এই প্রস্তাবের বিপরীতে প্রস্তাবের বিষয়ে রিভিউ করার সুযোগ রেখে দেয় পিডিবির জন্য। আর সেই সুযোগটিই নিয়েছে পিডিবি। গত সপ্তাহের সোমবার রিভিউ আপিল করে তারা। এক সপ্তাহের যাচাই-বাছাই শেষে নতুন সিদ্ধান্ত জানানো হলো।
দাম বাড়ানোর ঘোষণার পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধিতে জনগণের উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় সারা পৃথিবীতেই বিদ্যুৎ-জ্বালানির প্রাইস অ্যাডজাস্টমেন্ট করতে হচ্ছে। গ্রাহক পর্যায়ে এখনই দাম বাড়ছে না। দাম বাড়বে কি না, সেটাও নির্ভর করবে মাঠপর্যায়ের তথ্যের ভিত্তিতে। সবকিছু যাচাই-বাছাই করেই পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। বিইআরসি তাদের মতো করে বিবেচনা করেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর আগে তারা ঘোষণা দিয়েও দাম বাড়ায়নি। সবকিছু তারা যাচাই-বাছাই করেই সিদ্ধান্ত করেছে।
গত ২ নভেম্বর পিডিবি ও বিদ্যুৎ বিভাগের সাথে বৈঠক করে ঢাকা সফরকারী আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রতিনিধি দল। এরপর ৬ নভেম্বর বিইআরসির সঙ্গেও বৈঠক করে সংস্থাটি। জানা গেছে, ঋণ পাওয়ার অন্যতম শর্ত হচ্ছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ভর্তুকি কমানো। সে প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হচ্ছে বলে অনেকে মনে করছেন। বিইআরসির সঙ্গে আইএমএফ প্রতিনিধি দলের বৈঠকের কয়েকদিন পরই বাড়ানো হলো বিদ্যুতের দাম।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিয়ম ভেঙে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি করা হয়েছে। যা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। এ বিষয়ে ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-ক্যাবের জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. এম শামসুল আলম ঢাকা মেইলকে বলেন, বিইআরসির এ দাম ঘোষণা সম্পূর্ণ আইন বহির্ভূত। নিয়ম ভেঙে তারা দাম বৃদ্ধির ঘোষণা দিয়েছে। এটা অযৌক্তিক। কারণ রিভিউ হতে হলে উভয়পক্ষের লোকজন থাকতে হয়। তারা তো সেটা করেনি। উচ্চমূল্যের ডিজেল-ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রয়েছে। একই কারণে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি বন্ধ। এখন তো বিদ্যুতের দাম কমানো উচিত। কিন্তু অযৌক্তিকভাবে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি করা হয়েছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বিদ্যুতের দাম বাড়লে পণ্যমূল্য আরও বেড়ে যাবে এবং জনগণের জীবনে দুর্গতি নেমে আসবে। দাম বাড়ায় ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন নাগরিক সমাজের নেতারাও। তারা বলছেন, দাতা সংস্থাগুলোর চাপে পড়েই এ দাম বাড়ানো হয়েছে।
বাংলাদেশ সাধারণ নাগরিক সমাজের আহ্বায়ক মহিউদ্দীন আহমেদ বলেন, শুনানির পরিপ্রেক্ষিতে তারা মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত বাতিল করেছিল। আমরা কমিশন ও সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলাম। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের সাথে দাতা সংস্থাগুলোর বৈঠকের পর তাদের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হয়ে গেল।
দেশ ও দেশের জনগণের কথা কোনোভাবেই আমলে নিল না। বর্তমান বাজারে যে নৈরাজ্য চলছে এবং বিশৃঙ্খল অবস্থা তাকে আরেক ধাপ উসকে দেবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। বিইআরসি দাতা সংস্থার প্রেসক্রিপশন বাস্তবায়ন করার জন্য তাদের চাপে পড়েই এ দাম বাড়িয়েছে। চাপে পড়ে হোক বা অন্য যেভাবেই হোক এ সিদ্ধান্ত কতটা আত্মঘাতী হবে তা সামনের দিনগুলোতে বাজারের নৈরাজ্য এবং সেবার মূল্যবৃদ্ধিই বলে দেবে।
সর্বশেষ ২০২০ সালে ২৭ ফেব্রুয়ারি বাড়ানো হয়েছিল বিদ্যুতের দাম। পাইকারি, খুচরা ও সঞ্চালন- এই তিন পর্যায়ে তখন বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়। সাধারণ গ্রাহক পর্যায়ে (খুচরা) প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম গড়ে ৫ দশমিক ৩ শতাংশ বাড়িয়ে ৭ টাকা ১৩ পয়সা করা হয়। যা আগে ছিল প্রতি ইউনিট ৬ টাকা ৭৭ পয়সা। পাইকারিতে বিদ্যুতের দাম প্রতি ইউনিট গড়ে ৮ দশমিক ৪ শতাংশ বাড়িয়ে ৫ টাকা ১৭ পয়সা করা হয়। যা আগে ছিল প্রতি ইউনিট ৪ টাকা ৭৭ পয়সা।
ইউকে/এএস/আরএ