বিশেষ প্রতিবেদক: দীর্ঘ এক বছরের প্রতিক্ষার পর রাজশাহীর বাজারে নামলো জাতআম খ্যাত সুস্বাদু, মিষ্টি ও রসালো গোপালভোগ। রাজশাহী জেলা প্রশাসনের বেঁধে দেওয়া “ম্যাংগো ক্যালেন্ডার’ মেনে আজ থেকে বিভিন্ন বাগানের গাছ থেকে নামানো যাচ্ছে গোপালভোগ আম। এর আগে বমধুমাস জৈষ্ঠ্যের (১৫ মে) প্রথম দিন থেকে নামছে গুটি জাতের আম।
রাজশাহীর সব চেয়ে বড় আমের মোকাম পুঠিয়া উপজেলার বানেশ্বর হাট। বৃহস্পতিবার সকাল সেখানে গিয়ে দেখা গেছে আমের সরবরাহ বেড়েছে। তবে আমে বাজার ভরে উঠলেও বিশাল এই আমের হাটে এখনও লোকসমাগম কম। তবে আম বিক্রিতে ১১ দফা নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
রাজশাহীর বানেশ্বর হাটের ব্যাবসায়ী হোসেন আলী বাংলানিউজকে জানান, আজ হাটে গুটি জাতের আম বিক্রি হচ্ছে- ১ হাজার ২শ’ থেকে ১ হাজার ২শ’ টাকা মণ। আর সদ্য বাজার আসা গোপালভোগ আম বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৫ শ’ থেকে ২ হাজার টাকা মণ। তবে আমের সরবরাহ আজ থেকে বাড়লেও করোনা পরিস্থিতির কারণে সে তুলনায় ক্রেতাদের উপস্থিতি কম। আর লকডাউনের কারণে বাইরে থেকে এখনও পাইকারি ব্যবসায়ীরা আম নিতে রাজশাহীতে আসতে পারছেন না। তাই রাজশাহীর আম বাণিজ্য জমে উঠতে আরও কিছুটা সময় লাগবে বলে জানান এ ব্যবসায়ী।
এরই মধ্যে আজ পুঠিয়ার বানেশ্বর হাটে আম ক্রয়-বিক্রয় ও পরিবহনে ১১ নির্দেশনা দিয়েছে উপজেলা প্রশাসন। এতে বলা হয়েছে- কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে আম পরিবহনের ক্ষেত্রে অর্ডার নেওয়ার পর প্যাকেট থেকে আম চুরি বা অন্য কোনভাবে আম খোয়া গেলে সংশ্লিষ্ট কুরিয়ার সার্ভিসকে এর দায়ভার বহন করতে হবে ও ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
ওজন ও পরিমাপ মানদণ্ড আইন (২০১৮ এর ২৮ ধারাঃ ‘ব্যবসা বা বাণিজ্য) অনুযায়ী কোনো লেনদেন বা মালামাল সরবরাহের কাজে মেট্রিক পদ্ধতির অনুসরণ ব্যতীত অন্য কোনো পদ্ধতির ওজন বা পরিমাপন ব্যবহার করা যাবেনা।’ ২৮ ধারার ব্যত্যয় হলে ৪৫ ধারায় শাস্তির বিধানে বলা হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তি যদি ওজন বা পরিমাপ বা, ক্ষেত্রমত, সংখ্যামানের মানদণ্ড ব্যতীত, অন্য কোনো ওজন বা পরিমাপ বা সংখ্যামান ব্যবহার করেন, তালে তিনি অনূর্ধ্ব ছয় মাসের কারাদণ্ড অথবা অনূর্ধ্ব ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। এই আইন অনুযায়ী মেট্রিক পদ্ধতিতে ১ মণে ৪০ কেজি হয়। মণে কেনাবেচা হলে ৪০ কেজির বেশি দাবি করা আইনের দৃষ্টিতে অপরাধ।
যদি ৪০ কেজির বেশি কেনাবেচা করতে হয়, সেক্ষেত্রে, কেজিতে ক্রয়-বিক্রয় করার জন্য বলা হলো। কেজিতে ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে প্রতি কেজির দাম প্রথমে নির্ধারণ করতে হবে। আজ থেকে শোলা প্রথাও বাতিল করা হলো।
এছাড়া এখন থেকে নির্ধারিত খাজনার অতিরিক্ত টাকা আদায় করা যাবেনা। মহাসড়ক যানজটমুক্ত রাখতে হাটের নির্ধারিত স্থানে কেনাবেচা করতে হবে। বানেশ্বর বাজারের আম ব্যবসায়ীদের নিরাপত্তা, সার্বিক সহযোগিতা ও সুষ্ঠুভাবে বাজার পরিচালনার স্বার্থে প্রত্যেক আম ব্যবসায়ীকে উপজেলা প্রশাসনের মাধ্যমে নিবন্ধিত হতে হবে। বিগত সময়ে দেখা গেছে, অনেক আম ব্যবসায়ী হঠাৎ বাজারে এসে আম ক্রয় করে চাষিদের টাকা পরিশোধ না করে উধাও হয়ে গেছে। তাই চলতি বছর এই বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
আম ব্যবসায়ীরা আমের গায়ে আমের মূল্য লিখতে পারবেন না। আমের মূল্য সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী তার নির্ধারিত প্যাডে/স্লিপে/কাগজে/ চিরকোটে লিখে স্বাক্ষর করতে হবে। ব্যবসায়ীরা আমের গুণগত মান ও দর কষাকষি বাজারে শেষ করবেন। আড়তে গিয়ে নতুনভাবে দর কষাকষি ও চাষিকে হয়রানি করা যাবে না। ভ্যান বা ছোট গাড়িতে আম বানেশ্বর বাজারে আনা যাবে, কিন্তু ওই গাড়িগুলোতে মানুষ পরিবহন করা যাবে না। স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর, এমন কোন ধরনের ক্যামিকেল আমে ব্যবহার করা যাবে না। আম ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি মানা ও মাস্ক পরিধান করা বাধ্যতামূলক।
এদিকে, রাজশাহী জেলা প্রশাসনের সিদ্ধান্ত ও বেঁধে দেওয়া সময় অনুযায়ী, ১৫ মে থেকে পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন জাতের আম পাড়া শুরু হয়েছে। তবে কোনো আম আগে পাকলে স্ব-স্ব উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) জানাতে হবে। তার পরিদর্শন শেষেই গাছ থেকে নামানো যাবে আম।
রাজশাহীতে সাধারণত সবার আগে পাকে গুটি জাতের আম। জেলা প্রশাসনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ১৫ মে থেকে এই আমটি নামাতে পারছেন চাষিরা। আর উন্নতজাতের আমগুলোর মধ্যে গোপালভোগ ২০ মে, রাণীপছন্দ ২৫ মে, লক্ষণভোগ বা লখনা নামানো যাবে ২৫ মে থেকে এবং
খিরসাপাত বা হিমসাগর ২৮ মে থেকে নামানো যাবে। এছাড়া ল্যাংড়া আম ৬ জুন, আমরূপালি এবং ফজলি ১৫ জুন থেকে নামানো যাবে। আর সবার শেষে ১০ জুলাই থেকে নামানো যাবে আশ্বিনা ও বারি-৪ জাতের আম।
রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আলিম উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, গুটি আম প্রতি বছরই একটু আগে পাকে। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। তাই অনেকেই আজ গুটি আম নামাতে শুরু করেছেন। তবে আঁশযুক্ত এই আমের স্বাদ তুলনামূলক কম।
বিভিন্ন জাতের জনপ্রিয় আমের পরিপক্বতা আসার সময়কালের মধ্যে মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহে উঠছে গোপালভোগ আম। অত্যন্ত সুস্বাদু, আঁশ বিহীন, আটি ছোট আম। সাইজ মাঝারি, কেজিতে ৫টা থেকে ৬টা ধরবে। এর পর পাকা শুরু হবে ল্যাংড়া (হিমসাগড়) আম। তাই রাজশাহীতে জুনের প্রথম ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে জুনের দ্বিতীয় সপ্তাহে উঠবে ল্যাংড়া আম। নাম ল্যাংড়া হলেও এর স্বাদ অসাধারণ। আটি ছোট ও পাতলা, খোসা খুব পাতলা, রসালো, গায়ে শুধুই মাংসল। এভাবে পর্যায়ক্রমে রাজশাহীর সব আম পর্যায়ক্রমে নামতে শুরু করবে বলেও জানান ফল গবেষণা কেন্দ্রের এই বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা।
রাজশাহী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক কে জে এম আব্দুল আওয়াল বলেন, চলতি মৌসুমে রাজশাহীতে ৩৭৩ হেক্টর বাড়িয়ে ১৭ হাজার ৯৪৩ হেক্টর জমিতে আম চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। গত বছর ১৭ হাজার ৫৭৩ হেক্টর জমিতে আম চাষের লক্ষ্যমাত্রা ছিল। এবার উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে হেক্টর প্রতি ১১ দশমিক ৯ মেট্রিক টন। মোট উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা দুই লাখ ১৯ হাজার মেট্রিক টন। তাপদাহ কেটে গেলে আর নতুন কোনো প্রকৃতিক দুর্যোগ না আসলে এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে কোনো সমস্য হবে না বলেও মতামত রাজশাহী কৃষি বিভাগের এই কর্মকর্তার।
রাজশাহী জেলা প্রশাসক (ডিসি) মো. আবদুল জলিল বলেন, বেঁধে দেওয়া সময় অনুযায়ী কেবলমাত্র গাছে পাকলেই আম পাড়তে পারবেন চাষিরা। তবে যদি কোনো আম আগেই পেকে যায় সেগুলোও ভাঙতে পারবেন। কিন্তু এজন্য স্থানীয় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে বিষয়টি জানাতে হবে। তিনি বাগান পরিদর্শন করে আম পাকার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পরই চাষিরা তাদের গাছ থেকে নির্ধারিত সমেয়র আগেও আম নামাতে পারবেন বলে উল্লেখ করেন জেলা প্রশাসক।
রাজশাহীর বাগানগুলোয় আম ভাঙার বিষয়টি মনিটরিংয়ের জন্য সব উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, উপজেলা চেয়ারম্যান ও কৃষি কর্মকর্তাদের এরই মধ্যে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলেও জানান রাজশাহী জেলা প্রশাসক।
ইউকে /এসই/এসএম