তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগ: সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলো হয়ে উঠছে নানান অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড এবং সামাজিক ভারসাম্য বিনষ্টের অন্যতম মাধ্যম। প্ল্যাটফর্মগুলোতে রীতিমতো বিজ্ঞাপন দিয়ে বিক্রি হচ্ছে মাদকদ্রব্য।
আবার সামাজিক মাধ্যমে রীতিমতো ঘোষণা দিয়ে কেউ কেউ করছেন আত্মহত্যা। মাদক বিক্রি দীর্ঘদিন থেকেই বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং অ্যাপ প্ল্যাটফর্মে একরকম খোলামেলাভাবেই বিক্রি হচ্ছে মাদক দ্রব্য। মাদক ব্যবসায়ী, বিক্রেতা এবং ক্রেতারা নিজেদের মধ্যে নিরাপদ যোগাযোগ স্থাপনের জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেই তৈরি করে নিয়েছেন গোপন এক নেটওয়ার্ক। আর এক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে বেশি যে মাধ্যমটি ব্যবহৃত হচ্ছে সেটি হচ্ছে ফেসবুক।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, প্রথমে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মাদক কেনাবেচার যোগাযোগ সম্পন্ন হয়। এরপর সেই মাদক কুরিয়ার কোম্পানির মাধ্যমে পৌঁছে যায় গ্রাহকের হাতে। অনেক সময় মাদক বিক্রেতারাই কুরিয়ার কর্মীর ছদ্মবেশ নিয়ে মাদকদ্রব্য ডেলিভারি করে আসেন। আর এই কেনাবেচার অর্থের একটি বড় অংশ লেনদেন হয় বিভিন্ন মোবাইল ব্যাংকিং প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে। ফলে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্য চতুর এই নেটওয়ার্ককে শনাক্ত করা খুবই কঠিন হয়ে পড়ে।
তবে সম্প্রতি এমন একটি চক্রকে আটক করে পুলিশের অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিট (এটিইউ)। “ফাহিম অনলাইন সার্ভিস” নামে একটি ফেসবুক পেইজের মাধ্যমে মাদকদ্রব্য বিক্রি করা এক চক্রের মূল হোতাসহ তিন সদস্যকে আটক করে পুলিশ।
প্রতারণা করে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে অর্থ আদায়, মাদকদ্রব্য বিক্রয়, বিভিন্ন নেশা জাতীয় দ্রব্যাদি বিক্রয়সহ আমদানি নিষিদ্ধ যৌন উত্তেজক পণ্য বিক্রি করতেন তারা।
আত্মহত্যা
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটের এক সমীক্ষা অনুযায়ী, দেশে প্রতিদিন গড়ে ২৮ জন ব্যক্তি আত্মহত্যা করেন। তবে ভয়ানক তথ্য হচ্ছে, বৈশ্বিক মহামারি করোনার তুলনায় আত্মহত্যার সংখ্যা বেশি। পরিসংখ্যান ব্যুরোর এক তথ্যমতে, গেল অর্থবছরের (জুলাই ২০২০ থেকে জুন ২০২১) প্রথম ১০ মাসে অর্থাৎ চলতি বছরের এপ্রিল মাস পর্যন্ত দেশে করোনায় মৃত্যু হয়েছে প্রায় পাঁচ হাজার ২০০ জনের। কিন্তু একই সময়ে আত্মহত্যার সংখ্যা ১১ হাজারের বেশি।
এছাড়া সামাজিক সংগঠন ‘আঁচল’- এর তথ্যমতে, ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে আত্মহত্যার হার বেড়েছে ৪৪ দশমিক ৩৬ শতাংশ।
মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আত্মহত্যার এমন উদ্বেগজনক অবস্থার জন্য অন্যতম দায়ী সামাজিক যোগাযোগ ও ডিজিটাল মাধ্যমগুলো। আত্মহত্যা করা বা আত্মহত্যার চেষ্টা করা ব্যক্তিদের অনেকেই মানসিক অবসাদ ও বিষণ্নতা থেকেও এমনটা করছেন। তবে সেই বিষণ্নতার পেছনে অন্যতম দায়ী উপাদান সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও ইন্টারনেট।
বিগত ২১ ফেব্রুয়ারি মাদারীপুরের শিবচরে স্কুলছাত্রী লিপি আক্তার (১৭) বিষপানে আত্মহত্যা করে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে লিপির আপত্তিকর ও আন্তরঙ্গ মুহূর্তের কিছু ছবি ভাইরাল হলে লজ্জা আর ক্ষোভে আত্মহত্যা করে সে।
এছাড়া বিগত ২৪ মে ঝালকাঠি সদর উপজেলার বাসিন্দা ও স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষার্থী রাজু খান এবং ১ জুন রাজশাহীর বাসিন্দা আনারুল ইসলাম টুটুল (৪২) নামের একজন ফ্রিল্যান্সার ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে আত্মহত্যা করেন।
১৭ আগস্ট পারিবারিক জমিজমা সংক্রান্ত এবং মানসিক অশান্তির কারণে ফেসবুক লাইভে এসে আত্মহত্যা করেছেন সুমন (৩০) নামের এক জাদুশিল্পী। তার বাড়ি মৌলভীবাজার সদর উপজেলার কামালপুর ইউনিয়নের গয়ঘর এলাকায়।
সংশ্লিষ্টরা যা বলছেন
ইন্টারনেট প্ল্যাটফর্মে বিজ্ঞাপন দিয়ে মাদক বিক্রি এবং আত্মহত্যার মতো বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের সাইবার অপরাধ তদন্ত বিভাগের সিনিয়র সহকারী পুলিশ কমিশনার ধ্রুব জ্যোতির্ময় গোপ বলেন, অনলাইনে যদি কেউ মাদক বিক্রি করে বা করার চেষ্টা করে অথবা অফলাইনেও যদি করে সেটা পুলিশ হিসেবে আমরা শনাক্ত করার চেষ্টা করি। এমন তথ্য পেলে আমরা সংশ্লিষ্ট থানার পুলিশকে ‘ফরোয়ার্ড’ করি। এমনটা আগেও করেছি। কিন্তু বিষয় হচ্ছে, ফেসবুক বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যে কেউ যে কোন বিষয় দিয়ে দিতেই পারে। এমনটা আমাদের নজরে এলে ফেসবুককে জানাই। তারা তাদের কমিউনিটি গাইডলাইনের সাথে সাংঘর্ষিক কিছু পেলে সেগুলো সরিয়ে ফেলে। আবার কেউ যদি ক্রিমিন্যাল উদ্দেশ্য থেকে এমন কিছু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে করে তাহলে তখন আমরা অ্যাকশন নিই।
আত্মহত্যার মতো বিষয় নিয়ে ধ্রুব জ্যোতির্ময় আরও বলেন, আত্মহত্যা দেশীয় আইনেও একটি অপরাধ। এ ধরনের বিষয় আমাদের নজরে এলে গুরুত্ব দিয়ে সেগুলো আমরা দেখি। বেশ কয়েকটি ঘটনা আমরা প্রতিহত করতে সক্ষম হয়েছি। এমন বিষয়ে আমরা ফেসবুকের থেকেও ভালো সহযোগিতা পাই। দেখা যায়, ফেসবুকে আত্মহত্যার কোন পোস্ট এলে ফেসবুক নিজেরাই আমাদের সাথে যোগাযোগ করে সে বিষয়ে তথ্য দেয়। পোস্ট হওয়ার মাত্র এক ঘণ্টার মধ্যে তারা আমাদের জানিয়েছে এবং আমরা দ্রুত অ্যাকশন নিয়ে সেই আত্মহত্যা প্রতিহত করতে পেরেছি এমন ঘটনার নজির রয়েছে।
মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মোহিত কামাল বলেন, মানুষে মানুষে সরাসরি যোগাযোগ কমে যাওয়ায় তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশি আকৃষ্ট এবং অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে। এখনকার সময়ে বিভিন্ন অপরাধের সাথে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সম্পৃক্ততা পাওয়া যাবে। অপরাধ সংঘটনের চিন্তা থেকে শুরু করে পরিকল্পনা এবং তার বাস্তবায়নের কোন না পর্যায়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে পাবেন। এই অবস্থা থেকে আমাদের পরিত্রাণ পেতে হলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
ইউকে/এএস