২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা: দণ্ডপ্রাপ্ত অন্তত ৯ জন বিদেশে

বার্তাকক্ষ প্রতিবেদন: ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশে নৃশংস গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। ওই হামলায় আওয়ামী লীগের আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত হন, আহত হন কয়েকশ নেতাকর্মী।

সেদিন অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে গেলেও গ্রেনেডের প্রচণ্ড শব্দে শ্রবণশক্তি হারান আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

এরপর এই ঘটনায় দায়েরকৃত মামলার তদন্তে শুরু হয় নানান নাটক। তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার তদন্ত ভিন্ন খাতে নেওয়ার নানা চেষ্টা করে। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রাণ ফিরে পায় মামলাটি। বেশ কয়েকবার বাঁক বদলের পর বেরিয়ে আসতে থাকে আসল রহস্য। মূলত আওয়ামী লীগকে নেতৃত্ব শূন্য করতে বিএনপি-জামায়াত তথা চার দলীয় জোট সরকার রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে ইতিহাসের নৃশংসতম এই গ্রেনেড হামলা চালায়।

দীর্ঘ প্রতীক্ষা শেষে ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর ঢাকার এক নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিন আলোচিত গ্রেনেড হামলা মামলার রায় ঘোষণা করেন।

ভয়ংকর সেই গ্রেনেড হামলা ও হত্যাযজ্ঞের ঘটনায় মোট ৫২ জন আসামির মধ্যে তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন আদালত। একই সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, হারিছ চৌধুরীসহ ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এছাড়া বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে মোট ১১ আসামিকে।

বাকি তিনজনের মধ্যে হুজি নেতা মুফতি হান্নান ও শরীফ শাহেদুল আলমের ফাঁসি কার্যকর হয় ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর গ্রেনেড হামলা মামলায়। আরেক আসামি জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের ফাঁসি কার্যকর হয় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায়। তাই তাদের এই মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।

এদের মধ্যে লুৎফুজ্জামান বাবর এবং আব্দুস সালাম পিন্টুসহ অনেকেই বর্তমানে কারাগারে আছেন। রায় ঘোষণার সময় তারেক রহমান এবং হারিছ চৌধুরীসহ ১৮ জনকে মামলার নথিতে পলাতক দেখানো হয়েছিল। পরবর্তীতে পুলিশের সাবেক ডিআইজি খান সাইদ হাসান এবং ডিএমপির সাবেক উপকমিশনার ওবায়দুর রহমান খান আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। সর্বশেষ চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত ইকবাল নামে এক জঙ্গিকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। এর ফলে সর্বশেষ পলাতক রয়েছেন ১৫ জন, এরমধ্যে অন্তত ৯ জন বিভিন্ন দেশে অবস্থান করছেন বলে জানা গেছে।

মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ১৯ জন

আদালতের রায়ে ১৯ আসামিকে মৃত্যুদণ্ড ও ১ লাখ টাকা করে অর্থদণ্ড দেওয়া হয়। তারা হলেন- সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, মেজর জেনারেল (অব.) রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবদুর রহিম, হানিফ পরিবহনের মালিক মো. হানিফ, জঙ্গি নেতা মাওলানা তাজউদ্দিন, মাওলানা শেখ আবদুস সালাম, মাওলানা শেখ ফরিদ, মাওলানা আবু সাইদ, মুফতি মঈনউদ্দিন শেখ ওরফে আবু জান্দাল, হাফেজ আবু তাহের, মো. ইউসুফ ভাট ওরফে মাজেদ বাট, আবদুল মালেক, মফিজুর রহমান ওরফে মহিবুল্লাহ, আবুল কালাম আজাদ ওরফে বুলবুল, মো. জাহাঙ্গীর আলম, হোসাইন আহমেদ তামিম, রফিকুল ইসলাম ওরফে সবুজ ও মো. উজ্জ্বল ওরফে রতন।

তারেকসহ ১৯ জনের যাবজ্জীবন

আদালতের রায়ে ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা করে অর্থদণ্ড দেওয়া হয়। তারা হলেন- বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, বিএনপির নেতা হারিছ চৌধুরী, কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ, আরিফুল ইসলাম আরিফ, জঙ্গি নেতা মুফতি আবদুর রউফ, হাফেজ ইয়াহিয়া, মুফতি শফিকুর রহমান, মুফতি আবদুল হাই, মাওলানা আবদুল হান্নান ওরফে সাব্বির, মুরসালিন, মুত্তাকিন, জাহাঙ্গীর বদর, আরিফ হাসান ওরফে সুমন ওরফে আবদুর রাজ্জাক, আবু বকর সিদ্দিক ওরফে হাফেজ সেলিম হাওলাদার, মো. ইকবাল, রাতুল আহমেদ, মাওলানা লিটন, মো. খলিল ও শাহাদত উল্লাহ ওরফে জুয়েল।

দণ্ডিতদের মধ্যে বিদেশে যারা:

তারেক রহমান

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান গত প্রায় ১৩ বছর ধরে লন্ডনে অবস্থান করছেন। গ্রেনেড হামালা মামলায় তিনি যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। অভিযোগপত্রে তাকে পলাতক দেখানো হয়েছে।

তাজুল ইসলাম

মাওলানা তাজউদ্দীন হিসেবে পরিচিত তাজুল ইসলাম আব্দুস সালাম পিন্টুর ভাই। গ্রেনেড হামলার পর তাকে ভুয়া পাসপোর্টের মাধ্যমে বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। বর্তমানে তিনি দক্ষিণ আফ্রিকায় আছেন বলে জানা গেছে। গ্রেনেড হামলা মামলার রায়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে তাকে।

হারিছ চৌধুরী

বিএনপি সরকারের সময় প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সচিব ছিলেন তিনি। তৎকালীন সরকারে যাদের প্রভাব অনেক বেশি ছিল হারিছ চৌধুরী তাদের মধ্যে অন্যতম। গ্রেনেড হামলা মামলায় তাকে যাবজ্জীবন শাস্তি দেওয়া হয়েছে। ২০০৭ সালে সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতাসীন হবার পর দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান হারিছ চৌধুরী। বর্তমানে তার অবস্থান সম্পর্কে সঠিক তথ্য নেই। তবে তিনি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ একাধিক দেশে আসা যাওয়া করছেন বলে তদন্তকারী কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ

বিএনপির টিকিটে কুমিল্লা থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়া কায়কোবাদ গ্রেনেড হামলা মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামি। মামলার অভিযোগপত্রে তাকে পলাতক দেখানো হয়েছে। ধারণা করা হয়, তিনি সৌদি আরবে পলাতক রয়েছেন।

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এ টি এম আমিন

বিএনপি সরকারের সময় তিনি প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থার (ডিজিএফআই) দ্বিতীয় শীর্ষ ব্যক্তি ছিলেন। পরবর্তীতে সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় তিনি ডিজিএফআইর প্রধান হয়েছিলেন। সে সরকারের মেয়াদ শেষ হলে তিনি আমেরিকায় চলে যান। মামলার কাগজপত্রে তাকে পলাতক দেখানো হয়েছে।

লে. কর্নেল (অব.) সাইফুল ইসলাম নামে দণ্ডপ্রাপ্ত আরেক আসামি বর্তমানে কানাডায় অবস্থান করছেন বলে জানা গেছে।

হানিফ পরিবহনের মালিক মো. হানিফও বিদেশে পলাতক রয়েছেন। তবে তিনি কোন দেশে অবস্থান করছেন, বিষয়টি স্পষ্ট নয়। এছাড়া, গ্রেনেড হামলায় সরাসরি অংশগ্রহণকারী দুই জঙ্গি মুরসালিন ও মুত্তাকিন অস্ত্রসহ ধরা পড়ার পর প্রায় দেড় দশক ধরে ভারতের কারাগারে আছেন।

বাকি দণ্ডিত যারা:

লুৎফুজ্জামান বাবর

বিএনপি সরকারের সময় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করা লুৎফুজ্জামান বাবর ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় আটক হন। তখন থেকে তিনি কারাগারেই আছেন। গ্রেনেড হামলা মামলায় তিনি মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি।

আব্দুস সালাম পিন্টু

বিএনপি সরকারের সময় শিক্ষা উপমন্ত্রী ছিলেন আব্দুস সালাম পিন্টু। তারেক রহমানের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল বলে জানা যায়। গ্রেনেড হামলা মামলার রায়ে তাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আদালত। বর্তমানে তিনি কারাগারে রয়েছেন।

আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ

জামায়াতে ইসলামীর সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল মুজাহিদ ছিলেন গ্রেনেড হামলা মামলায় অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আসামি। কিন্তু যুদ্ধাপরাধ মামলায় তার ফাঁসি কার্যকর হওয়ায় গ্রেনেড হামলা মামলা থেকে তার নাম বাদ দেওয়া হয়।

মুফতি হান্নান

উগ্র ইসলামপন্থী দল হরকাতুল জিহাদের নেতা ছিলেন তিনি। গ্রেনেড হামলা মামলার মূল আসামি। তার স্বীকারোক্তির মাধ্যমেই গ্রেনেড হামলা মামলায় মোড় ঘুরে যায়। মুফতি হান্নানের স্বীকারোক্তির পর তারেক রহমান এবং লুৎফুজ্জামান বাবরসহ অনেককেই এ মামলার আসামি করা হয়। সিলেটে গ্রেনেড হামলা চালিয়ে তিনজনকে হত্যার দায়ে ২০১৭ সালে তার ফাঁসি কার্যকর করা হয়। সে গ্রেনেড হামলায় ঢাকায় নিযুক্ত তৎকালীন ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরী আহত হয়েছিলেন।

মেজর জেনারেল (অব.) রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী

আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর তাকে আটক করা হয়। প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থার (ডিজিএফআই) প্রধান ছিলেন তিনি। গ্রেনেড হামলা মামলায় তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে তিনি কারাগারে রয়েছেন।

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আব্দুর রহিম

তিনি জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) সাবেক মহাপরিচালক। গ্রেনেড হামলা মামলায় অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। তিনি কারাগারে বন্দি থাকা অবস্থায় সম্প্রতি করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হন। গত ১৫ আগস্ট রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।

গ্রেনেড হামলার সময় পুলিশ প্রধান শহুদুল হক ও ডিএমপি কমিশনার মোহাম্মদ আশরাফুল হুদাকে মামলার রায়ে দুই বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। দীর্ঘদিন কারাগারে বন্দি থাকার পর দুইজনই ২০১৯ সালে জামিনে মুক্ত হন। গ্রেনেড হামলা হওয়ার পর তাদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলে রাষ্ট্রপক্ষ। কারণ হামলার পর ঘটনাস্থল একবারও পরিদর্শন করেননি শহুদুল। তিনি এক সময় সেনা কর্মকর্তা ছিলেন। পরে তাকে পুলিশ বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করেন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। ২০০১ সালে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর শহুদুল হককে পুলিশ প্রধানের পদে চুক্তি ভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়।

ইউকে/এএস