প্রবেশন: জেলের বাইরে সংশোধনের সুযোগ পাচ্ছে অপরাধীরা

নিজস্ব প্রতিবেদক: রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার ছোট নারায়নপুর গ্রামের শিল্পী (২৮) এবং আসামি জাকির (৩১) ও তার স্ত্রী সায়মার (২৮) মধ্যে গোবর তোলাকে কেন্দ্র করে ঝগড়া শুরু হয়। এক কথা, দুই কথায় শুরু হয় মারামারি।

তারা লাঠি দিয়ে মারধর করে শিল্পীকে। এ ঘটনায় শিল্পী বাদী হয়ে ছয়জনের বিরুদ্ধে মামলা করে।
পরে আদালতে সায়মা ও জাকিরের বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণিত হয়। তবে রায় ঘোষণাকালে আসামিপক্ষ জানায়, আসামি সায়মা পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। তখন আদালত অপরাধীদের বয়স, অপরাধের ধরণ বা প্রকৃতি, ঘটনার পারিপার্শ্বিকতা, পেশা ইত্যাদি বিবেচনা করে এক বছরের প্রবেশন মঞ্জুর করে শর্ত সাপেক্ষে বাড়িতে থেকেই সংশোধনের সুযোগ দেন।

প্রবেশন অফিসার মতিনুর রহমান ও লাইজু সিদ্দীক নিয়মিত আসামিদের তত্ত্বাবধান করেন। তাদের সঠিক পথে আনার জন্য পরামর্শ দেন। এক পর্যায়ে দুই পক্ষকে মুখোমুখি করেন।

সায়মা ও জাকির শিল্পীর কাছে ক্ষমা চায়। আঘাতের কারণে আসামিরা শিল্পীকে আদালতের নির্দেশনা মতে ক্ষতিপূরণও দেয়। শিল্পীও তাদের ক্ষমা করে দেয়। প্রবেশনকালে গত ১২ মার্চ দণ্ডপ্রাপ্ত সায়মা কারাগারের পরিবর্তে বাড়িতেই ফুটফুটে পুত্র সন্তানের জন্ম দেয়। জাকির ও সায়মা প্রবেশনকাল সফলভাবে শেষ করায় বুধবার মামলা থেকে অব্যাহতি পান।

শুধু সায়মা ও জাকিরই নয়, বুধবার মামলা থেকে চূড়ান্তভাবে অব্যাহতি পেয়েছে বাগমারা থানার পানিশাইল গ্রামের গোলাম রব্বানীও (২৫)। অভিযোগকারী আবুল কালামের বোনের সাথে আসামির প্রেমের বিয়ের কারণে বিরোধের সূত্রপাত।

ঘটনার দিন উত্তেজিত গোলাম রব্বানী ভিকটিম আবুল কালামকে মারধর করলে সাত জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়। ভাই-বোনের মধ্যে সম্পর্ক আরও খারাপ হয়। আদালতে আসামি গোলাম রব্বানীর বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণ হয়। কিন্তু আদালত তাকে কারাগারে না পাঠিয়ে বয়স, শিক্ষাগত যোগ্যতা, মামলার প্রকৃতি ও গুরুত্ব বিবেচনায় এক বছরের প্রবেশন মঞ্জুর করেন।

আদালত শর্তসাপেক্ষে বাড়িতে থেকেই সংশোধনের সুযোগ দেন। প্রবেশনকালে আসামি নিজ এলাকার তিনজনকে অক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন করিয়েছেন। তারা এখন স্বাক্ষর করতে পারেন। নিজ এলাকায় গাছ লাগিয়েছেন। আদালতের নির্দেশনার নিজ এলাকায় মাস্ক বিতরণ করেছেন এবং জনসচেতনতা লক্ষ্যে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করেছেন। প্রবেশনকালে আসামি স্থানীয় স্কুল থেকে বই নিয়ে পড়েছে এবং কী কী বই পড়েছে তার সারমর্ম আদালতে জমা দিয়েছে।

উভয় মামলা থেকে আজ প্রবেশনপ্রাপ্ত আসামিদের চূড়ান্তভাবে অব্যাহতি দেন সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. সাইফুল ইসলাম।

এদিকে, রাজশাহী জেলায় ৫৫ জন এবং রাজশাহী মহানগর এলাকায় ১৫ জনসহ মোট ৭০ জন এ আইনের অধীনে সুবিধা পেয়েছে। এর মধ্যে ৩০ জন সফলভাবে প্রবেশনকাল শেষ করেছেন। তারা প্রত্যেকেই এখন মুক্তধারার আলোকে আলোকিত মানুষ। তবে দুজন প্রবেশনের শর্ত ভাঙায় কারাগারে সাজা ভোগ করেছেন।

রাজশাহী প্রবেশন অফিসার মতিনুর রহমান বলেন, এর মাধ্যমে আসামিদের সংশোধনের পাশাপাশি অপরাধের কারণ নির্ণয় করে পুনর্বাসিত করা হচ্ছে। আসামিদের দক্ষতা বাড়াতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। বিভিন্ন সেবামূলক কর্মসূচির আওতাভূক্ত করা হচ্ছে। ফলে অপরাধের পুনরাবৃত্তি হচ্ছে না। প্রবেশনারদের অপরাধপ্রবণতার হার মাত্র ৬.২৫ শতাংশ। যা বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর তুলনায় কম।

বেসরকারি সংস্থা ব্লাস্টের জেলা প্রকল্প কর্মকর্তা অ্যাডভোকেট কানিজ ফাতেমা বলেন, ছোটখাটো অপরাধে অপরাধীদের সংশোধনে সরকারের সাথে বেসরকারি সংস্থাগুলো অনুদান, আইনি সহায়তা এবং বিভিন্ন তথ্য দিয়ে এই কার্যক্রমকে এগিয়ে নিতে পারে। এটি সফল হলে কারাগারগুলোতে যেমন বন্দিদের চাপ কমবে তেমনি আপিল আদালতগুলোতেও মামলার জট কমবে।

প্রবেশন কি?

প্রবেশন হচ্ছে- অপরাধীদের সংশোধনের এমন একটি বিশেষ পদ্ধতি, যেখানে দণ্ডিত কোনো ব্যক্তিকে কারাগারে না পাঠিয়ে সমাজের নিজ পরিমন্ডলে থেকে সংশোধন ও পুনর্বাসনের উদ্দেশ্যে শর্তসাপেক্ষে প্রবেশন অফিসারের অধীনে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য মুক্তি দেওয়া হয় এবং কোনো শর্তভঙ্গ হলে স্থগিত সাজা ভোগের জন্য কারাগারে যেতে হয়। ‘দ্য প্রবেশন অব অফেন্ডার্স অর্ডিন্যান্স’ ১৯৬০ ও শিশু আইন ২০১৩ মোতাবেক এ সুবিধা পাওয়া যায়।

এ দুটি আইনের আওতায় আদালতকে সহায়তা করার জন্য, অপরাধীকে দেওয়া শর্তাবলি। যা যথাযথভাবে পালিত হচ্ছে কিনা তা পর্যবেক্ষণ করার জন্য এবং তাদের তত্ত্বাবধান ও সংশোধনী কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সমাজসেবা অধিদফতরের প্রবেশন অফিসার দায়িত্ব পালন করেন। মৃত্যুদণ্ড ছাড়া অন্য সকল অপরাধে নারীদের প্রবেশন মঞ্জুর হয়। পুরুষদের প্রবেশন দেওয়ার কিছু সীমাবদ্ধতা আছে।

ইউকে/এএস